'পুতুল ' শব্দটি সংস্কৃত ' পুত্তলিকা ' থেকে এসেছে যার অর্থ মৃত্তিকাদি নির্মিত প্রতিমূর্তি। "পুতুল কল্পনায় মানবমনের অপরূপ ভাবনার চিহ্ন আছে। প্রকৃতপক্ষে এটি মানুষের সংস্কৃতিগত বিবর্তনের এবং মানুষের মনন- কল্পনার ভাবসমৃদ্ধ অনন্য মূর্তি।" মনে করা হয়, মানুষের অনুকরণস্পৃহা, সংকেতপ্রবণতা, অনিষ্টকারী শক্তিকে বশে আনার ভাবনা ও অলৌকিকত্বে বিশ্বাস থেকেই পুতুলের জন্ম। যে মাধ্যমে গড়া হোক না কেন, এর মধ্যে কল্পনার যে অবাধ বৈচিত্র্য, শৈলীর যে নানাবিধ অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় তা দেশ, কাল, সম্প্রদায়ের গন্ডী অতিক্রম করে সহজ সৌন্দর্যকেই দ্যোতিত করে।
দীপলক্ষ্মী বা দেওয়ালি পুতুল দীপাবলি উৎসবের সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে যুক্ত। তবে এর প্রথম প্রচলন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের মতে, "৫২৭ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে কার্তিক মাসে স্বাতিনক্ষত্রে অমাবস্যার রাত্রি শেষে জৈনগুরু মহাবীরের নির্বাণপ্রাপ্তি হলে তাঁর নির্বাণস্থান পাবা নগরীতে দীপদানোৎসব হইয়াছিল।(হরিবংশ) ইহাই দীপাবলীর মূল বলিয়া উক্ত।" আবার অনেকে মনে করেন, রামচন্দ্র রাবনবধ করে সীতাকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরলে তাঁদের আগমন হেতু আলোর উৎসবের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানই দীপাবলি।
দেওয়ালি পুতুল পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর এবং হাওড়া জেলার কিছু জায়গায়; এছাড়া ঝাড়খন্ড, ওড়িষা ও পূর্ববঙ্গের মৈমনসিংহ অঞ্চলের কুম্ভকার শিল্পীরা মাটি দিয়ে নির্মাণ করেন যদিও স্থানভেদে এদের আঙ্গিক ও চিত্রণে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়।
অনেক গবেষক মনে করেন, দেওয়ালি পুতুল শিল্পীদের আদি বাসভূমি বিহার, রাণীগঞ্জ, ছোটোনাগপুর মালভূমি অঞ্চল। জীবন- জীবিকার টানে তাঁরা সেখান থেকে পুরুলিয়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। তারপর ক্রমশ মেদিনীপুর, বাঁকুড়া প্রভৃতি এলাকায় লোকশিল্পের এই ধারা ছড়িয়ে পড়ে। তাই ঘাগরা কাঁচুলি পরিহিতা পুতুলের আদলে অবাঙালি ছাপ লক্ষ্য করা যায়। আবার অনেকে মনে করেন, এই গড়ন কুমোরপাড়ার নিজস্ব শৈলী।
এগুলি পোড়ামাটির পুতুল। পোয়ানে পোড়ানোর পর কোনো কোনো অঞ্চলে রঙ করা হয়, কোথাও আবার ওই অবস্থাতেই রেখে দেওয়া হয়।এগুলির দৈর্ঘ্য ৩০ সেমি. থেকে ২ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। পুতুলের নিচের অংশটি সাধারণত গোলাকার লম্বা চাকে তৈরি ওল্টানো গ্লাসের মতো বা দীপদানের মতো যাকে রাঢ় অঞ্চলে 'দেরকো' বলা হয়। ওপরের অংশে একটি নারী মূর্তি দুই বা চার বা দশ হাতে এক বা একাধিক প্রদীপ ধরে থাকে। প্রদীপসজ্জা নানা ধরণের। কখনো দেখা যায়, নারীমূর্তিটি প্রসারিত দুই হাতে মাথার উপর দিয়ে বিস্তৃত একটি অর্ধবৃত্তাকার বেষ্টনী ধরে আছে এবং সেই বেষ্টনীর গায়ে তিন/ চার/ পাঁচ/ সাত/ দশ/তেরো/ ষোলোটি প্রদীপ বসানো রয়েছে। সাত প্রদীপযুক্ত দেওয়ালি পুতুলকে পুরুলিয়ায় 'সাতবহানিয়া' বলা হয়ে থাকে। পুরুলিয়া জেলার পুরুলিয়া শহর ছাড়াও বলরামপুর , ঝালদা, আদ্রা, ছাতাটাঁড় প্রভৃতি এলাকায় এই পুতুল পাওয়া যায়। কখনো আবার নারীমূর্তিটিকে বাঘ বা ঘোড়ার পিঠে প্রদীপ হাতে বসে থাকতে দেখা যায়।
মেদিনীপুরের মানিকপুর ও মির্জাবাজার এলাকার দেওয়ালি পুতুলে বিশেষত্ব রয়েছে। প্রথাগত প্রদীপ সজ্জার পাশাপাশি এখানে নারীমূর্তির দুই হাতে সলতে লাগানোর ব্যবস্থা সমেত কেরোসিনের কুপি লক্ষ্য করা যায়। স্থানীয়ভাবে এগুলিকে 'পরীপুতুল' বলা হয়। লোকসংস্কৃতি গবেষক তারাপদ সাঁতরা মনে করেন, এই ধরণের প্রদীপ নির্মাণের ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের মৃৎশিল্পীরা উদ্ভাবনী বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। প্রদীপ দ্রুত নিভে যাওয়ার সম্ভাবনায় তাঁরা কেরোসিন কুপি যুক্ত করে পুতুলগুলিকে বেশ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে তুলেছেন।
**********
তথ্যসূত্রঃ-
১. পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পীসমাজ- তারাপদ সাঁতরা, ২০০০।
২. বাংলার লোকশিল্প - কল্যানকুৃমার গঙ্গোপাধ্যায়, ১৩৬৮।
৩. পশ্চিমবঙ্গের মৃৎশিল্প- দীপঙ্কর ঘোষ, ২০০২।
৪. জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস-বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, ১৯৯৪।
ক্ষেত্রসমীক্ষা ও লোকশিল্প সংরক্ষণে - আশিস চক্রবর্তী ও অমলেন্দু বেরা
No comments:
Post a Comment