হুগলি ও রূপনারায়ণ নদের সঙ্গমস্থলে হাওড়া জেলার দক্ষিণতম ভূখণ্ড হল 'গাদিয়াড়া ' ( উত্তর-২২°১৩' ও দক্ষিণ- ৮৮°০২') যার পূর্বে দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও দক্ষিণে পূর্ব মেদনীপুর অবস্থিত।এর নামকরণ সম্পর্কে স্থানীয় মানুষদের ধারণা, রূপনারায়ণের দক্ষিণ পাড়ের গেঁওখালি থেকে আড়া তৈরির জন্য গরাণ কাঠ একত্রিত করে ( স্থানীয় ভাষায় গাদাগাদি করে) বেঁধে এই অঞ্চলে আনা হত এবং এখান থেকে দক্ষিণ হাওড়ার বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি করা হত।তাই এই আড়ার গাদি বা স্তুপ থেকে নামকরণ 'গাদিয়াড়া' হয়েছে বলে মনে হয়।
পুরাতন দলিলপত্রে এবং ১৯০৯ সালে প্রকাশিত Howrah District Gazetteer-এ এই স্থানকে ' মাকড়া পাথর ' নামে উল্লেখ করা হয়েছে(মাকড়া শব্দের অর্থ হল ঝামা পাথর)। এখনো গাদিয়াড়া ফেরীঘাট থেকে ১০০ মিটার পূর্বে নদীর বাঁধের ধারে একটি বট গাছের নিচে কয়েকটি কালো রঙের শিলাকে মাকড়চন্ডী নামে পুজো করা হয়। আগে এর অবস্থান ছিল ২০০ ফুট দক্ষিণে।নদীর বিস্তৃতির জন্য এখন উত্তরে সরিয়ে আনা হয়েছে।
বিভিন্ন গবেষণায় এই স্থানটিকে ' James and Merry Sand' নামেও উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ ১৬৯৪ সালে সেপ্টেম্বর মাসে জেমস্ অ্যান্ড মেরী নামে একটি জাহাজ বালেশ্বর থেকে হুগলী নদীর মুখে ঢোকার সময় তাম্বোলী পয়েন্টের এক চড়ায় ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায়। Bengal letter to court, এর এক জায়গায় বলা হয়েছে - " Tamboli point is shown in the pilot chart 1703 at the present site of Fort Mornington Point. " ইংল্যান্ডের রাজা জেমস্ ও রানী মেরী অফ্ মডেনার নামে জাহাজটির নাম থাকায় চড়াটির এমন নাম হয়েছে বলে মনে করা হয়। অতীতে এর অবস্থান ছিল হুগলি নদীর প্রায় মাঝবরাবর।
বর্তমানে কেবল এর পূর্ব দিক দিয়ে স্রোত প্রবাহিত হলেও আগে এর পশ্চিম দিকেও প্রবল স্রোত ছিল।
অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পর্যবেক্ষণে জানিয়েছেন, রূপনারায়ণ ও দামোদরের খাত পরিবর্তিত হওয়াতেই এই চড়ার সৃষ্টি। দুদিক দিয়ে স্রোত থাকায় প্রচন্ড ঘূর্ণি ছিল যার প্রভাবে জাহাজ চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৬৭৬ সালে Streyn-shyam Master নামের এক ইংরেজ ক্যাপ্টেন তাঁর দিনলিপিতে সেকথার উল্লেখ করেছেন। এই চড়া প্রায় তিন মাইল দীর্ঘ ও অাধ মাইল প্রস্থ ছিল। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর 'পরিব্রাজক' গ্রন্থে লিখেছেন "নীচে মহাভয় James and Merry চড়া। পূর্বে দামোদর নদ কলকাতার ৩০ মাইল উপরে গঙ্গায় এসে পড়ত।এখন কালের বিচিত্র গতিতে তিনি ৩১ মাইলের উপর দক্ষিণে এসে হাজির। তার প্রায় ৬ মাইল নীচে রূপনারায়ণ জলকাদা ঢালছেন, মণিকাঞ্চন যোগে তাঁরা তো হুড়মুড়িয়ে আসুন,কিন্তু এ কাদা ধোয় কে?কাজেই রাশীকৃত বালি। সে স্তুপ কখন এখানে, কখন ওখানে,কখন একটু শক্ত,কখন বা নরম হচ্চেন।সে ভয়ের সীমা কি!দিন রাত তার মাপজোখ হচ্ছে, একটু অন্যমনস্ক হলেই --দিন কতক মাপজোখ ভুললেই জাহাজের সর্বনাশ। সে চড়ায় ছুঁতে না ছুঁতেই অমনি উলটে ফেলা,না হয় সোজাসুজিই গ্রাস!! এমনও হয়েছে,মস্ত তিন মাস্তুল জাহাজ লাগবার আধ ঘন্টা বাদেই খালি একটু মাস্তুল মাত্র জেগে রইলেন। এ চড়া দামোদর রূপনারায়ণের মুখই বটেন। দামোদর এখন সাঁওতালি গাঁয়ে তত রাজি নন,জাহাজ স্টীমার প্রভৃতি চাটনি রকমে নিচ্চেন।১৮৭৭খ্রীঃ অব্দে কলকেতা থেকে ' কাউন্টি অফ স্টারলিং ' নামক এক জাহাজে ১৪৪৪ টন গম বোঝাই নিয়ে যাচ্ছিল। ঐ বিকট চড়ায় যেমন লাগা আর তার আট মিনিটের মধ্যেই ' খোঁজ খবর নাহি পাই'।১৮৭৪ খ্রীঃ ২৪০০ টন বোঝাই একটি স্টীমারের দুমিনিটের মধ্যে ঐ দশা হয়। ধন্য মা তোমার মুখ !"
এখানকার অন্যতম স্থাপত্য হল ' ফোর্ট মর্নিংটন পয়েন্ট ' নামের একটি ভগ্ন দুর্গ যা রূপনারায়ণ টুরিস্ট লজের ( অতীতে এই স্থানে বিশালক্ষ্মী রাইস মিল ছিল এবং বর্তমানে এর প্রধান প্রবেশ পথের ডানদিকের স্থাপত্যটি Heritage building এর মর্যাদা পেয়েছে ) সামনে নদীর পাড় থেকে ২৫ মিটার পূর্বে অবস্থান করছে।
অনুমান করা হয়, শত্রুর রণতরীকে কামানের পাল্লার ভিতর রাখবার জন্য সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই স্থানে লর্ড ক্লাইভ দুর্গটি নির্মাণ করেন।লর্ড ক্লাইভ-এর প্রথম শাসনকাল ১৭৫৬-১৭৬০ সাল।এরপর তিনি স্বদেশে ফিরে যান।কিন্তু ১৭৬৫ সালে মীরজাফরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নাজিম- উদ্-দৌলাকে কোম্পানি সিংহাসনে বসালেও তাঁর কর্মচারীদের দূর্নীতির কারণে সর্বত্র বিশৃঙ্খলা প্রবলভাবে দেখা দেয়। কোম্পানির ভাঁড়ারে রাজস্বেও টান পড়ে। এমতাবস্থায় কোম্পানি ক্লাইভকে দ্বিতীয় বার ভারতে নিয়ে এসে বাংলার গভর্নর নিযুক্ত করে পাঠান(১৭৬৫-১৭৬৭)।এই পর্বেই দুর্গটি নির্মিত বলে অনেকে মনে করেন।তবে দুর্গটির এরূপ নামকরণের কারণ অস্পষ্ট। ব্রিটিশ শাসনে Rechard Colley Wesley -কে 'The Earl of Mornington ' বলা হত।কিন্তু তিনি বাংলার গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন ১৭৯৮ থেকে ১৮০৫ সাল পর্যন্ত। লর্ড ক্লাইভের মৃত্যু হয় ১৭৭৫ সালে।সুতরাং তাঁর পক্ষে এই নামকরণ করা অসম্ভব ।হতে পারে 'মর্নিংটন 'নামটি অনেক পরে করা হয়েছে। অবশ্য স্থানীয় প্রবীন মানুষদের বংশপরম্পরায় বাহিত ধারণা অনুযায়ী, এটি ক্লাইভের অনেক অাগে নির্মিত একটি বিশ্রামাগার । মুসলিম শাসনে বেতড় থেকে তাম্রলিপ্ত যাওয়ার পথে জাহাজ নোঙর করে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য চুন,সুরকি ও মোটা মজবুত কাঠ দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছিল। ব্রিটিশ আমলে সেটাই সংস্কার করে গোপন দুর্গ বানানো হয়,যা পরে 'ফোর্ট মর্নিংটন পয়েন্ট 'নামে পরিচিতি লাভ করে।১৯৪২ সালের ভয়ঙ্কর বন্যায় দুর্গটি বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।স্থানীয় মানুষেরা ধ্বংসস্তুপ থেকে অনেক ইট,কাঠ নিয়ে চলে যায়। বর্তমানে শুধুমাত্র ভাঁটার সময় ইটের লম্বা সুড়ঙ্গ পথ সহ নিমজ্জিত দুর্গের বিভিন্ন অংশ দেখা যায়।
*********
তথ্যসূত্রঃ
১. ৫০০ বছরের হাওড়া-হেমেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,১৯৯২
২. বাঙ্গালীর ইতিহাস (অাদি পর্ব)- ১ম -খন্ড -নীহার রঞ্জন রায়, ১৩৫৯
৩. হাওড়া জেলার ইতিহাস -২য় খন্ড - অচল ভট্টাচার্য, ১৯৮২
৪. হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৭৬
৫. হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার - অমিয় কুমার ব্যানার্জী,১৯৭২
৬. বিবেকানন্দ সমগ্র - ১ম খন্ড, ১৯৯৭
অনুসন্ধানে - আশিস চক্রবর্তী ও অমলেন্দু বেরা
প্রকাশিত - 'প্রতিদিনের গেরো ' পাক্ষিক পত্রিকা( ১৫ আগষ্ট ২০০৭)
No comments:
Post a Comment