হাওড়া জেলার দক্ষিণে শ্যামপুর থানার অন্তর্গত শিবগঞ্জের(২২.২৫°উ, ৮৮.০৭°পূ) পূর্ব নাম ছিল কাশেমনগর বা কাশিমনগর।ঔরঙ্গজেবের প্রশাসনিক দপ্তরের কাশেম খাঁ আনুমানিক সতেরো শতকে এখানে একটি মসজিদ (?) নির্মাণ করেছিলেন, যার দৈর্ঘ্য ৫৩ ফুট,প্রস্থ ২৩ ফুট ও উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট ছিল।মসজিদটির ছাদ চার দেওয়ালের কোনে উদ্গত লহরার উপর রক্ষিত তিনটি গম্বুজ দ্বারা নির্মিত ছিল। কাশেম খাঁ- এর নামানুসারেই এই গ্রামের নাম হয় কাশেমনগর। পুরানো দলিলপত্রে স্থানটিকে কাশিমনগর হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে।
অনেকে বলেন,কাশেম খাঁ নির্মিত স্থাপত্য মসজিদ নয় দরগা। কারণ কাশেম খাঁ নিজে পীরের উপাসক ছিলেন। মসজিদের পুকুরকে কেউ কেউ পীরের পুকুর ও বলে থাকে। সাধারণত কোনো মসজিদে মানত করার কোনো প্রথা নেই। কিন্তু এখানে যারা আসে তারা সবাই মানত করে এবং পূর্বে এখানে মানত করে মাটির ঘোড়া উৎসর্গ করার প্রথা ছিল। কাশেম খাঁ নির্মিত স্থাপত্যটি বর্তমানে লুপ্ত। সেখানে নতুন করে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। এটি তিন গম্বুজ মসজিদ।মসজিদের পাশের মাঠে একটি ভগ্নপ্রায় প্রাচীন দেওয়ালের অংশ দেখা যায়, যাকে অনেকে ঘোড়ার আস্তাবল বলে মনে করেন।ঘোড়া পীরের বাহন। মসজিদের পিছনের দেওয়ালে একটি ডিম্বাকার খাঁজ(cave) থাকে। মৌলবি সেখানে বসেন পূর্ব দিকে মুখ করে এবং উপাসকরা তাঁর দিকে মুখ করে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে মুখ করে প্রার্থনা করেন।এই মসজিদে তেমন কোনো খাঁজ নেই। এসব কারনে এটিকে অনেকে পীরের দরগা বলে মনে করেন। মসজিদটি চক্রবর্তী পরিবার অধ্যুষিত অঞ্চলে অবস্থিত। এ গ্রামে কোনো মুসলমান ধর্মাবলম্বী নেই। তাই পার্শ্ববর্তী কামদেবপুর ও তেঁতুলবেড়িয়া গ্রামের মুসলিমরাই এই মসজিদের দেখভাল করেন। সরকারি নথিতে এটিকে মসজিদ হিসাবেই চিহ্নিত করা হয়েছে।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে দুর্ভিক্ষ ও প্রবল বন্যায় স্থানীয় মুসলমান অধিবাসীরা অন্যত্র চলে গেলে গ্রামটি পরিত্যক্ত হয়। এরপর আনুমানিক ১৮৫০ সালে নারিট- গাজীপুরের জমিদার শিব রায় এই কাশেমনগরের খেয়াঘাটের কাছে একটি হাট বসান।ক্রমশ এলাকাটি গঞ্জ হয়ে ওঠে এবং তাঁর নামেই কাশেমনগরের নাম বদলে হয় শিবগঞ্জ। বর্তমান মোল্লাহাটে জমিদার শিব রায়ের একটি কাছারি বাড়ি ছিল।
লোকশ্রুতি অনুযায়ী,মসজিদের পুরানো ইটে একবার বাঘের পায়ের ছাপ পাওয়া গিয়েছিল। তবে বাঘের উপস্থিতির সত্যতা থাক বা না থাক এই অঞ্চলটি যে একসময় জঙ্গলাকীর্ণ ছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ গ্রামের উত্তর পাড়ায় বাঘ বাহনে আসীন বিশালাক্ষী দেবীর মন্দির আছে যা আনুমানিক ২০০ বছরের পুরানো। তবে মাটির তৈরি প্রাচীন মন্দিরটি সংস্কার করে ইটের করা হয়েছে। মন্দিরে বিশালাক্ষী ছাড়াও লক্ষ্মী, সরস্বতী, গনেশ,মনসা প্রভৃতি দেবদেবীও রয়েছেন। এই মন্দিরে পৌরহিত্য করেন হেমন্ত চক্রবর্তীর পূর্ব ও উত্তরসূরীরা।এছাড়াও সূর্য মন্ডলের বাড়ির পাশে রাঢ় বাংলার অরণ্যদেবতা দক্ষিণ রায় দীর্ঘকাল ধরে পূজিত হয়ে আসছেন।
কথিত আছে, মতিলাল চক্রবর্তীর জমিতে একবার এক ফকির এসে মাটির তিনটি ঢিপি তৈরি করেছিলেন। সেখানে সেই থেকে ওলাবিবির পূজা হয় প্রত্যেক মাঘী পূর্ণিমায় এবং সেই ঢিপি অস্থায়ী।
গ্রামের শীতলা মন্দিরটি শরৎ নন্দীর বাবা সদয় নন্দী নির্মাণ করেছিলেন। পৌরহিত্যের দায়িত্ব দিয়েছিলেন আশিস চক্রবর্তীর ঠাকুরদার জ্যাঠামশাই মতিলাল চক্রবর্তীর উপর। এটি শিব- শীতলা মন্দির।
গ্রামে স্বর্গীয় শরৎ নন্দীর নামে একটি সমাধি মন্দির ও বৃষকাষ্ঠ আছে। বৃষকাষ্ঠ হল হিন্দুদের শ্রাদ্ধে নিবেদিত প্রায় ৬-৭ ফুট দীর্ঘ ও ৫-৭ ইঞ্চি ঘনত্বের বেল বা নিম কাঠের তৈরি একটি নকশা - খোদাই স্তম্ভ। একে 'বৃষধ্বজ' বা 'বেরোষ' ও বলা হয়। 'শুদ্ধি তত্ত্ব' ও 'মৎসপুরাণে' এর উল্লেখ রয়েছে। চৌপল স্তম্ভটিকে কুঁদে একজন পুরুষ বা নারীর ( যার শ্রাদ্ধ হচ্ছে সেই অনুযায়ী) মূর্তিকে ভারবাহী করে ২- ৩ টি শিবলিঙ্গ শোভিত মন্দির খোদাই করা হত। তারপর নানাবিধ রঙের প্রয়োগ করে নিচের দিকের কিছুটা অংশ জলাশয়ের কাছে পুঁতে দেওয়া হত। বাংলার সূত্রধর সমাজের শিল্পীরাই এগুলি নির্মাণ করত যা বর্তমানে অবলুপ্ত। হাওড়া জেলার বিশিষ্ট বৃষকাষ্ঠ শিল্পী ছিলেন কৃষ্ণবাটি গ্রামের পরান দাস,গড়বালিয়ার কিশোরী দাস,বাগনানের যোগীন কুন্ডু ও কিশোরী সাঁই এবং শ্যামপুরের গণেশচন্দ্র মান্না।
তথ্য সূত্রঃ-
১. ৫০০ বছরের হাওড়া-হেমেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,১৯৯২
২. পশ্চিমবাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য মন্দির মসজিদ - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৯৮
৩. হাওড়া জেলার ইতিহাস -২য় খন্ড - অচল ভট্টাচার্য, ১৯৮২
৪. হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৭৬
৫. হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার - অমিয় কুমার ব্যানার্জী,১৯৭২
৬.বাংলার কাঠের কাজ- তারাপদ সাঁতরা, ২০০৩
৭.বাংলার লোকশিল্প -ড. প্রদ্যোত ঘোষ,২০০৪
অনুসন্ধানে - আশিস চক্রবর্তী ও অমলেন্দু বেরা
প্রকাশিত - 'প্রতিদিনের গেরো ' পাক্ষিক পত্রিকা( ১লা মে, ২০০৭)
No comments:
Post a Comment