হাওড়া জেলার দক্ষিণে শ্যামপুর থানার অন্তর্গত গণেশপুর গ্রামের (২২.৩৫°উ, ৮৮.০৪°পূ) নামকরণ সম্পর্কে জনশ্রুতি হল, এই গ্রাম যাঁরা পত্তন করেন তাঁরা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁকটিয়া থেকে এসেছিলেন। তাঁদের পদবি ছিল ঘোড়া। এঁদেরই প্রভাবশালী এক পুরুষের নাম ছিল গণেশ। তাঁরই নামানুসারে গ্রামের নাম হয় গণেশপুর।
গ্রামের অন্যতম পুরাকীর্তি হল লক্ষ্মী- জনার্দনের ( শালগ্রাম) পূর্বমুখী নবরত্ন মন্দিরটি। এই মন্দিরের ত্রিখিলান অলিন্দের ছাদ অর্ধবৃত্তাকার খিলানের দ্বারা এবং গর্ভগৃহের ছাদ চার দেওয়ালের কোনে উদ্গত লহরার উপর রক্ষিত নয়টি গম্বুজের দ্বারা নির্মিত। ভিতরের বারান্দায় বাম দিক দিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি পথে ত্রিতল এই মন্দিরের ছাদে ওঠা যায়। মন্দিরটি দৈর্ঘ্য প্রস্থে ২১'(৬.৪ মি.) এবং উচ্চতায় আনুমানিক ৪০'(১২.২মি.)।
কথিত আছে, বর্ধমান রাজার অধীনে চৈতন্যচরণ রায়ের কোনো এক পূর্বপুরুষ এ অঞ্চলে জমিদারি কিনে ' ভূস্বামী' হন এবং পূর্বের 'ঘোড়া' পদবি পরিবর্তন করে 'রায়' পদবি গ্রহণ করেন। কিন্তু গ্রামের লোকেরা আড়ালে ছড়া কেটে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েনি -
" ঘোড়া থেকে রায় হল
চাবুক খেয়ে প্রাণ গেল। "
তবে জমিদার চৈতন্যচরণ ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ । তিনি মা মেলাইচন্ডীর স্বপ্নাদেশে দামোদর নদীর তীরে বর্তমান জোয়ারকোল গ্রামের উত্তর- পূর্ব কোণে চাঁপাইখালি নামক স্থান থেকে মেলাইচন্ডী দেবীকে শিলামূর্তি অবস্থায় তুলে এনে গণেশপুরে মেলাই চণ্ডীর মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। তারই কিছুদিন পরে বহু অর্থ ব্যয়ে পাশে লক্ষ্মী- জনার্দন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।
মন্দিরের সামনের বাঁকানো কার্নিশের নিচে পোড়ামাটির ফলকে দু'পঙক্তির নিম্নলিখিত প্রতিষ্ঠা লিপিটি উৎকীর্ণ আছে : "শ্রী শ্রী রামচন্দ্র। সুভমস্তু সকাবদ্দা ১৭৪২ সক।সন ১২২৭ সাল। তাং ৯ই বৈশাখ পুস্যা নক্ষত্র। /বৃহস্পতিবার আরম্ভ কিত্তি শ্রী চৈতন্যচরণ রায়।গঠনাথ শ্রী রামপ্রসাদ চন্দ্র মিস্ত্রিরী সাং রাঔতাড়া।" অর্থাৎ ১৭৪২ শকাব্দ বা ১২২৭ বঙ্গাব্দ বা ১৮২০ খ্রীঃ চৈতন্যচরণ রায়ের নির্দেশে রাওতাড়া নিবাসী স্থপতি রামপ্রসাদ চন্দ্র মন্দিরটি নির্মাণ করেন। হাওড়া জেলার সেকালের যশস্বী মন্দির স্থপতি ছিলেন রামপ্রসাদ চন্দ্র। তিনি মোট তিনটি মন্দির নির্মাণ করেন;ঝিকিরায়,গনেশপুরে ও কল্যানপুরে। ফলে মন্দিরগুলির ভাস্কর্যশৈলীর মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান। জেলার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য মন্দির-স্থপতিরা হলেন অভয়চরণ মিস্ত্রি, রামমোহন মিস্ত্রি, রাজনারায়ণ মিস্ত্রি, সুকদেব মিস্ত্রি, হৃষীকেশ মিস্ত্রি, গোপাল কর্মী, গুইরাম সূত্রধর,মহেশচন্দ্র সেন প্রমুখ।
পঙ্খসজ্জা (Stucco) সেকালের মন্দির- স্থাপত্যে একটি অন্যতম শিল্পশৈলী হিসেবে বিবেচিত হত। পোড়ামাটির ভাস্কর্য (টেরাকোটা) সৃষ্টি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে মূলত উনিশ শতক থেকে পঙ্খসজ্জা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পঙ্খের অলংকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়, জোংড়া বা বাখারি চুনকে (শামুক -ঝিনুক পুড়িয়ে প্রস্তুত চুন) কয়েকদিন ভিজিয়ে রাখর পর সেটিকে জল থেকে তুলে একটা পরিস্কার কাপড়ে বেঁধে জল ঝরে যাওয়া পর্যন্ত ছাই বা বালির গাদায় রেখে দেওয়া হয়।তারপর ঐ চুনের সঙ্গে পরিমাণমতো গুড় ও অন্যান্য দ্রব্য মিশিয়ে প্রস্তুত পলেস্তারাটি নির্দিষ্ট জায়গায় লেপে দেওয়া হয়। এরপর 'সুর্মা' বা নরুনের মতো ছোটো সরু লম্বা বাটালি দিয়ে খোদাই করে ইচ্ছে মতো নকশা তৈরি করা হয়।
লক্ষ্মী- জনার্দন মন্দিরের ভিতরের দেওয়ালে ওপরের দিকে কিছু পঙ্খের অলংকরণ এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। কয়েক বছর পরে হয়তো তার আর কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। অলংকরণগুলির একটিতে রয়েছে প্রস্ফুটিত ফুলের বৃন্তের দুধারে দুটি পাখি পরস্পর বিপরীতমুখী এবং ঠিক ওপরের ফুলের পাপড়ির মধ্যে ঠোঁট ডুবিয়ে বসে থাকা অন্য দুই পাখি পরস্পর মুখোমুখি। এই চিত্রটি একটি বৃত্তের মধ্যে অলঙ্কৃত। এছাড়া ফুল লতাপাতার নকশা বিদ্যমান। তবে মন্দিরের সামনের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে টেরাকোটার কাজ। পঙ্খসজ্জা ও টেরাকোটার যুগপৎ অবস্থান দেখে অনুমান করা যায় যে টেরাকোটার ক্রমঅবলুপ্তির যুগে পঙ্খের অলংকরণ প্রসার লাভ করেছিল। এই মন্দিরটি সেই সন্ধিলগ্নের শিল্পসুষমাকে ধারণ করে আছে।
মন্দিরের সামনের প্রবেশপথের ওপরের অংশে নিবদ্ধ পোড়ামাটির ফলকগুলি কোথাও ওপর থেকে নিচে আবার কোথাও ভূমির সমান্তরালে বাম দিক থেকে ডান দিকে সার দিয়ে সাজানো । তবে অনেকগুলি ফলক বর্তমানে লুপ্ত।
কার্নিশের নিচে ওপরের সারিতে বাম দিক থেকে ডান দিকে --->১) মৎস্য অবতার, ২) কূর্ম অবতার, ৩) কল্কি অবতার, ৪) জগন্নাথ - বলরাম- সুভদ্রা, ৫) হংসবাহনে উপবিষ্ট চতুর্মুখ ব্রহ্মা, ৬) হস্তিপৃষ্ঠে উপবিষ্ট ইন্দ্র, ৭) মহিষাসুরমর্দিনী, ৮).................., ৯) ব্রহ্মা, ১০) গৌর-নিতাই, ১১) রাধাকৃষ্ণ, ১২) জগাই - মাধাই, ১৩) কালী, ১৪) রাবন।
নিচের সারিতে বাম দিক থেকে ডান দিকে ---> ১) নৃসিংহ অবতার, ২) বামন অবতার, ৩) রাম- বলরাম, ৪) নৃত্যরত বালক- বালিকা, ৫) পুরুষ ও মহিলার কাঁখে একটি করে শিশু, ৬) ভগীরথের গঙ্গা আনয়ণ, ৭)..........., ৮)..........., ৯) নারীমুখ, ১০) ঢেঁকিপেতে বসে আছে পুরুষ ও নারী, ১১) বীণা হাতে নারদ, ১২) বিশ্বামিত্র - রাম- লক্ষ্মণ, ১৩) যুদ্ধরত রাম- লক্ষ্মণ, ১৪) তলোয়ার হাতে রাক্ষসদ্বয়।
উপরোক্ত সমান্তরাল সারি দুটির মাঝে মাঝে একটি করে মোট ছয়টি মূর্তি রয়েছে। বাম দিক থেকে ডান দিকে ---> ১) সিঙ্গা হাতে দণ্ডায়মান পুরুষ, ২) মৃদঙ্গবাদনরত দণ্ডায়মান পুরুষ, ৩) বাহুতুলে নৃত্যরত পুরুষ, ৪) অনুরূপ, ৫) ২-এর অনুরূপ, ৬) ১- এর অনুরূপ।
মন্দিরের সামনের দেওয়ালের একদম বামদিকে প্রান্তে উপর থেকে নিচে ---> ১) কৃষ্ণ - সুদামা, ২) কংস বধ, ৩) উন্মত্ত হস্তি ও কৃষ্ণ, ৪) কালীয়দমন, ৫) পার্থসারথি, ৭)..........., ৮)........., ৯).............১০)............, ১১)........্ ১২).............।
ডানদিকের প্রান্তে ওপর থেকে নিচে ---> ১) গাছ থেকে কৃষ্ণ ফল পাড়ছে,নিচে পাহারাদার, ২) অনুরূপ, ৩) বসুদেব কৃষ্ণকে কোলে নিয়ে যাচ্ছে, ৪) রাধাকৃষ্ণ, ৫) গোদোহন, ৬) ঢেঁকিবাহনে নারদের সামনে কৃষ্ণ, ৭) যশোদা- নন্দের মাঝে কৃষ্ণ, ৮)........, ৯).........., ১০).........., ১১)........।
মন্দিরের তিনটি প্রবেশপথের চারটি স্তম্ভের উপরে একটি করে মোট চারটি টেরাকোটার সজ্জা লক্ষ্য করা যায়,যা ওপর থেকে নিচের দিকে লম্বমান। একেবারে বামে ---> ১)দুটি বাঘের উপর তরবারি হাতে উদ্যত দু'জন সৈনিক, ২) দুটি বাঘের উপর দুটি হাতি,তার উপর দু'জন সৈনিক, ৩) দুটি সিংহের উপর দুটি হাতি, তার উপর দু'জন সৈনিক। এরপরের সজ্জায়----> ১) দুটি সিংহের উপর দুজন সৈনিক, ২) দুটি সিংহের উপর দুটি হাতি, তার উপর দুজন সৈনিক, ৩) দুটি ঘোড়ার উপর দুটি হাতি, তার উপর সৈনিক, ৪) দুটি সিংহের উপর দুটি ঘোড়া, তার উপর দু'জন সৈনিক। পরের সারিতে---> ১) দুটি বাঘের উপর দু' জন সৈনিক, ২) দুটি বাঘের উপর দুটি হাতি, তার উপর দুজন সৈনিক, ৩) দুটি ঘোড়ার উপর দুটি হাতি, তার উপর দুজন সৈনিক, ৪) দুটি বাঘের উপর দুটি ঘোড়া, তার উপর দুজন সৈনিক। ডানদিকে ধারে---> ১) দুটি সিংহের উপর দুজন সৈনিক, ২) দুটি হাতির উপর দুজন সৈনিক, ৩).........।
মন্দিরের বাইরের তিনটি প্রবেশদ্বার পেরিয়ে আবার তিনটি প্রবেশদ্বার। মূল মন্দিরের বামে ও একেবারে ডানদিকে কানে মাকড়ি ও পায়ে মল পরিহিতা এবং হাতবায়া বাদনরতা চারফুট দীর্ঘ দুটি নারীমূর্তি রয়েছে। মাঝে দ্বারের দু'পাশে দুটি করে চারটি মূর্তি; দুটি দ্বাররক্ষক ও অপর দুটি বীণাবাদনরতা নারী। বলাবাহুল্য, টেরাকোটার মূর্তিগুলির মধ্যে পৌরানিক ও লৌকিক ধারার সমন্বয় ঘটেছে ।
মন্দিরের বামপাশে দ্বিতল বিশিষ্ট ভগ্নপ্রায় জমিদার বাড়িটি ইতিহাসের ভারবাহী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন আইন ২০০১ এর ২ নং ধারা অনুসারে বর্তমানে দুটি মন্দিরকেই সংরক্ষিত ও ঐতিহ্যসম্পন্ন পুরাকীর্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
**********************
তথ্য সূত্রঃ-
১. হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৭৬
২. পশ্চিমবাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য মন্দির মসজিদ - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৯৮
৩. হাওড়া জেলার ইতিহাস -২য় খন্ড - অচল ভট্টাচার্য, ১৯৮২
৪. হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার - অমিয় কুমার ব্যানার্জী,১৯৭২
৫. বাংলার কাঠের কাজ- তারাপদ সাঁতরা, ২০০৩
৬. হাওড়া জেলা লোকউৎসব - তারাপদ সাঁতরা, ২০০৫
৭. বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ-দুলাল চৌধুরী, ২০০৪
৮. বাংলার মন্দির :স্থাপত্য ও ভাস্কর্য- প্রণব রায়, ১৯৯১
অনুসন্ধানে - আশিস চক্রবর্তী ও অমলেন্দু বেরা
প্রকাশিত - 'প্রতিদিনের গেরো ' পাক্ষিক পত্রিকা ( ১লা জুলাই , ২০০৭)
No comments:
Post a Comment