✍️ আশিস চক্রবর্তী ও অমলেন্দু বেরা
হাওড়া জেলার দক্ষিণে শ্যামপুর থানার অন্তর্গত ডিহি মন্ডলঘাট গ্রামের (২২.২৯°উত্তর ৮৭.৯৬° পূর্ব) ঐতিহাসিকতা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। 'ডিহি' ফারসি শব্দ যার অর্থ তালুক বা ছোট জমিদারি বা কয়েকটি মৌজার সমষ্টি। ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৫৮২ খ্রীষ্টাব্দে টোডরমলের রাজস্ব এলাকা বিভাগের সময় বর্তমান হাওড়া জেলার সমগ্র অংশ সুবা বাংলার যে তিনটি 'সরকার'-এ (সাতগাঁ, সুলিয়ামানাবাদ এবং মান্দারন) বিভক্ত করা হয়, তার মধ্যে মান্দারন সরকারের অন্তর্গত ছিল মন্ডলঘাট পরগণা। অবশ্য আইন-ই-আকবরীতে বলা হয়েছে, প্রথমদিকে মন্ডলঘাট ছিল সরকার মান্দারনের একটি 'মহল' মাত্র, পরে পরগণায় রূপান্তরিত হয়। মুর্শিদকুলি খাঁর শাসনতান্ত্রিক সংস্কারে ১০০ গ্রামে ১টি পরগণা হত।পরগণাগুলির মধ্যে মন্ডলঘাট ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর আয়তন ছিল ১,৭৮,৭৫৬ একর বা ২৭৯.৩১ বর্গমাইল। জনসংখ্যা ১,৪২,৬৬৬। ১৭০৩ সালে জন থর্ণটন কৃত পাইলট চার্টে দামোদর নদকে 'মন্ডলঘাট নদ' হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে। তার কারণ হয়তো গুরুত্বপূর্ণ এই পরগণার মধ্যে দিয়ে দামোদর নদের নিম্নগতি প্রবাহ। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাম্রলিপ্ত বন্দরের সঙ্গে এই মন্ডলঘাট পরগণার আদান-প্রদান চলত। আইন-ই-আকবরী অনুসারে মন্ডলঘাট পরগনার রাজস্ব ছিল ৯,০৬,৭৭৫ দাম।
এই 'মন্ডলঘাট' নামকরণ প্রসঙ্গে বলা যায়, সেন বংশের বিখ্যাত রাজা ছিলেন বল্লাল সেন। তাঁর একজন মহামান্ডলিক বর্তমান দাসপুর থানার (পূর্ব মেদিনীপুর) মহিষঘাটার অধিবাসী মহেশ মন্ডল। তাঁরই নামানুসারে এই মন্ডলঘাট পরগনার নামকরণ।
বর্তমান ডিহি মন্ডলঘাট গ্রামটি উক্ত পরগণার কেন্দ্র ছিল বলে মনে হয়। বৃটিশ আমলে রূপনারায়ণ তীরবর্তী এ অঞ্চলটি Tamluk Salt Agent - এর অন্তর্গত লবন উৎপাদন ও বাণিজ্যের আড়তে পরিণত হয়েছিল বলে জানা যায়।
গ্রামের অন্যতম পুরাকীর্তি হল দক্ষিণাকালীর ত্রিখিলান অলিন্দযুক্ত দালান মন্দির।মন্দিরটি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে প্রায় ২০'৬" (৬.৩ মি.) এবং উচ্চতায় ১২' (৩.৭ মি.)। চতুর্ভুজা দেবীর কালো কষ্টিপাথরের বিগ্রহটি মন্দিরের ডানদিকের পুকুর ( যা এলাকায় 'কালিদহ' নামে পরিচিত) খননের সময় পাওয়া যায়, যার উচ্চতা আনুমানিক ১৫ সেমি. ও প্রস্থ ৭.৫ সেমি.। জনশ্রুতি, মন্দিরের বর্তমান সেবায়েত ঘোষাল পরিবারের পূর্বপুরুষ জনৈক দুর্গাপদ ঘোষালের বিধবা মাকে দেবী স্বপ্নাদেশ করেন এবং তারপর মন্দির নির্মাণ করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাগনানের খালোড় কালীমন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা স্থানীয় ভূস্বামী কন্দর্পনারায়ণ মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন বলে কথিত আছে, যদিও এই কন্দর্পনারায়ণ সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাওয়া যায় না। সেবায়েতদের অভিমত অনুযায়ী, একসময় বর্ধমানের রাজা মন্দিরের নামে বেশ কিছু জমি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে দান করেছিলেন যার অধিকাংশই বর্তমানে দখলদারির কারণে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে।
মন্দিরে একটি প্রাচীন পশুবলির খাঁড়া রয়েছে যার গায়ে বঙ্গাক্ষরে '১০৮১ সাল' খোদিত ছিল, তবে মরিচা পড়ায় এখন আর তা স্পষ্ট নয়। ঐ খাঁড়ায় পশুবলি হয় না, বলির জন্য আলাদা খাঁড়া ব্যবহৃত হয়। দেবী প্রথমে চন্দনকাঠের সিংহাসনে অধিষ্ঠিতা ছিলেন। প্রায় ৮০ বছর আগে তাতে আগুন লেগে পুড়ে যায়। বর্তমানের সিংহাসনটি সেই সময়ের তৈরী।
সুদূর অতীতে এ অঞ্চলে যে একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল, তার প্রমাণ রয়েছে। অতীতে মন্দির সংলগ্ন কালিদহ পুকুরে খননের সময় নললাগানো বিভিন্ন ধরনের পোড়ামাটির পাত্র পাওয়া গিয়েছিল। স্থানীয় বেরা পরিবারের পুকুর খুঁড়তে গিয়ে পোড়ামাটির বেড় দেওয়া পাতকুয়া এবং ইটের রাস্তাও পাওয়া গিয়েছিল বলে স্থানীয় প্রবীণদের মত। তবে শুধুমাত্র এই গ্রামেই নয়, রূপনারায়ণ ও দামোদর নদ তীরবর্তী সমগ্র শ্যামপুরে বিভিন্ন স্থানে খুঁড়তে গিয়ে প্রাচীন মূর্তি ও মৃৎপাত্র পাওয়া গিয়েছে একাধিক বার। যথাযথ অনুসন্ধান চালালে হয়তো আরও অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে। কালীমন্দিরের কাছে যেখানে হাট বসে তার পাশে বটগাছের তলায় কয়েকটি সিঁদুর মাখানো নুড়ির সাথে একটি পোড়ামাটির অদ্ভুত দর্শন মুখাবয়ব দেবী ষষ্ঠী হিসেবে পূজিত হতেন যার সঙ্গে দক্ষিণ ২৪ পরগণার বারা ঠাকুরের (দক্ষিণ রায় ও নারায়ণী) আদলের মিল ছিল। তবে সাম্প্রতিক আমফান বিপর্যয়ে বটগাছটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মুখাবয়বটি ভেঙে টুকরো হয়ে যায়।
গ্রামের বনেদি বংশ হল বিশ্বাস ও বেরা। এখন যেখানে ডিহিমণ্ডলঘাট হাইস্কুল অবস্থিত, পূর্বে সেখানে পত্তনিদার বিশ্বাসদের কাছারি বাড়ি ছিল। তারই নিকটে আনুমানিক ১৫০ বছর পূর্বে সীতাপতি বিশ্বাসের পূর্বপুরুষ রামলাল বিশ্বাস পশ্চিমমুখী কমলেশ্বর শিবমন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। দৈর্ঘ্য প্রস্থে ১২'৩" (৩.৭ মি.) এবং প্রায় ৩০'(৯.২ মি.) উচ্চতা বিশিষ্ট এই মন্দিরের গর্ভগৃহের ছাদ চার দেওয়ালের কোনে উদ্গত লহরা নির্ভর গম্বুজের উপর স্থাপিত। পূর্বে সামনের দেওয়ালে পঙ্খের অলংকরণ ছিল কিন্তু বর্তমানে তার কোনও চিহ্ন নেই। পাশের রাস্তা থেকে প্রায় ১০ ফুট উঁচু ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরের নোনাধরা দেওয়ালে কালের থাবা স্পষ্ট। এখানে ওখানে গাছ ও লতা গজিয়ে উঠেছে। বিশেষত নিচের দিকের বিভিন্ন অংশ থেকে ইট খসে পড়ছে। যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে পুরাতত্ত্বের এমন অনবদ্য নিদর্শনটি সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যাবে।
গ্রামের শীতলা মন্দিরটি কালীমন্দিরের সমসাময়িক। ঘটের উপর শিলা দেবী রূপে পূজিত হন। প্রতিষ্ঠাতা রাজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নামের জনৈক তান্ত্রিক। জনশ্রুতি অনুযায়ী, বর্তমান বাঁধানো বকুল গাছের পাশে কুটিরে তিনি থাকতেন। প্রথমে মন্দিরটি মাটির দেওয়াল, তালপাতার ছাউনি ছিল। বর্ধমানের মহারাজ একবার বেড়াতে এসে ঐ তান্ত্রিককে মদনমোহনজীর একটি পেতলের মূর্তি ও ৩২ বিঘা জমি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে দান করেন। আন্টিলাপাড়ার জনৈক বিন্দুবাসিনী দেবী এ মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর স্থানীয় মাজি বংশের কর্তারা পার্শ্ববর্তী বরদাবাড় গ্রামের হরিপদ মিশ্রকে পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত করেন। সেই থেকে তাঁর উত্তরসূরীরা পূজা করে আসছেন। ৬০ বছর আগে মদনমোহন মূর্তিটি চুরি হয়ে যায়। বর্তমানে মন্দিরে শীতলা দেবী ছাড়াও মনসা, পঞ্চানন্দ, জ্বরাসুর, দক্ষিণরায়, রূপ রায়, পাঁচুগোপাল ও রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ রয়েছে। মাটির মন্দিরটিকে কংক্রিটের তৈরি করে দেন জহরলাল মাজি। নব কলেবর হয় ৪ ঠা মার্চ ১৯৭৬ সালে। এরপর ২০১৯ সালের ৭ মে জহরলাল মাজির উত্তরসূরীরা মন্দিরের সংস্কার করেন।
*******************
তথ্য সূত্রঃ-
১.হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৭৬
২. হাওড়া জেলার ইতিহাস(২য় খন্ড) -অচল ভট্টাচার্য, ১৯৮২
৩. আইন- ই- আকবরী - আবুল ফজল( অনু. - পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়,২০১৭
৪. Bengal District Gazetteer Howrah - L.S.S. Omalley, 1909
৫. A Statistical Accounts of Bengal ( vol.- 3) - W.W.Hunter,1875
মানচিত্রঃ-
১. ১৭০৩ সালের ইংলিশ পাইলট চার্ট
No comments:
Post a Comment