হাওড়া জেলার দক্ষিণে শ্যামপুর থানার অন্তর্গত নুনেবাড় গ্রামের (২২.২৮°উ, ৮৭.৯৮°পূ) নামকরণ সম্পর্কে প্রামাণ্য কোনো নথি পাওয়া যায় না। তবে যে জনশ্রুতিটি রয়েছে তা হল 'বাড়' শব্দের অর্থ ধার বা তীরভূমি। অঞ্চলটি রূপনারায়ণের নোনাজল বিধৌত; সেকারণেই গ্রামের নাম নুনেবাড়।
৬৮৯ টি পরিবার নিয়ে গঠিত এই গ্রামের সত্তাধিকারী ছিলেন বর্তমান হাওড়া-হুগলী সীমানায় অবস্থিত ঝিকিরা-প্রতাপপুরের রায় বংশের পত্তনিদাররা। ললিতমোহন রায়, কিশোরীমোহন রায় প্রমুখ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। পূর্বে এই গ্রামের শিবমন্দিরের দক্ষিণে রায়েদের কাছারি বাড়ি ছিল।
গ্রামের পূর্ব দিক দিয়ে প্রবাহিত নুনেবাড়- কোটরা নামে পরিচিত খালটি কমলপুর হাটের উত্তর দিক দিয়ে গিয়ে কোটরার জয়চন্ডী পাড়ার কামিনীঘাটায় শেষ হয়েছে। এই খালপথটি পূর্বে এত চওড়া ছিল যে ৪০০- ৫০০ মণের বোট অনায়াসে যাতায়াত করতে পারতো। এক সময় এই খালের জলবন্টন নিয়ে কমলপুরের ঘোষ এবং এখানকার রায় পত্তনিদারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাঁধে। শেষ পর্যন্ত নুনেবাড় থেকে কিছু জমি কমলপুরের ঘোষদের দেওয়ার বিনিময়ে মীমাংসা হয় ও খালে জল ফেলার ছাড়পত্র মেলে।
গ্রামের অন্যতম পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনটি হল পঞ্চানন্দ মন্দিরের বিগ্রহ যা আসলে কষ্টিপাথরের ভগ্ন বিষ্ণুমূর্তির ওপরের অংশ।উচ্চতা প্রায় আড়াই ফুট। আনুমানিক ১৩০০ বঙ্গাব্দে নুনেবাড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তর দিকে বিবেকানন্দ সামন্তের পূর্বপুরুষ ভজহরি সামন্তের পুকুর খননের সময় এই বিগ্রহটি পাওয়া যায়। পরবর্তী কালে তাঁর স্ত্রী সুন্দরীবালা সামন্ত স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে সেটিকে পঞ্চানন্দ রূপে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। বিগ্রহটির সঙ্গে খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ -ত্রয়োদশ শতকের ভাস্কর্য শৈলীর মিল রয়েছে ।
১৯৭০- ১৯৭৫ সাল নাগাদ স্থানীয় গোপীবল্লভ সামন্তের পুকুর খনন কালে মাটির তলায় সারিবদ্ধ ভাবে ৩৮x২৫x৬ সে.মি. মাপের অনেক ইট পাওয়া গিয়েছিল। যেগুলির একদিকে একটি সরু কাঠের গুঁড়ি এবং তাকে আটকে রাখার জন্য দু'পাশে দুটি কাঠের গোঁজ মাটিতে পোঁতা অবস্থায় ছিল।
এখানকার প্রাচীন শিবমন্দিরটি রায় পত্তনিদারদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হলেও শিবের দেবত্র সম্পত্তি বর্ধমান রাজার দান।সমগ্র হাওড়া জেলার নানা গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য শিবমন্দিরের উৎপত্তির ইতিহাসের কোনো প্রামাণ্য নথি আজ আর পাওয়া সম্ভব নয়। তবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই সাধারণ যে জনশ্রুতিটি রয়েছে তা হল, সেগুলি বর্ধমান রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছে। এর কারণ, ১৭২২ খ্রীষ্টাব্দে মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে এবং ১৭২৪ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর জামাতা সুজাউদ্দিনের আমলে ভূমিরাজস্ব বিধি সংশোধনের জন্য হাওড়া সদর মহকুমার বিরাট অংশ ও সমগ্র উলুবেড়িয়া মহকুমা বর্ধমান জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয়। এই জমিদাররা ধর্মপ্রাণ ছিলেন। শিবমন্দিরের সম্বৎসর পূজা অর্চনার জন্য অনেক জমি তাঁরা দেবত্র সম্পত্তি হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। গ্রামের মানুষদের মুখে এখনো শোনা যায় 'শিবের পুকুর', 'শিবের জমি' ইত্যাদি। যদিও পরবর্তী কালে সেই সব জমি জায়গা দখলদারির কারণে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
বর্ধমান জমিদারির এই অঞ্চলটি অতীতে মন্ডলঘাট পরগনার মধ্যেই ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৫৮২ খ্রীষ্টাব্দে টোডরমলের রাজস্ব এলাকা বিভাগের সময় বর্তমান হাওড়া জেলার সমগ্র অংশ সুবা বাংলার যে তিনটি 'সরকার'-এ (সাতগাঁ, সুলিয়ামানাবাদ এবং মান্দারন) বিভক্ত করা হয় তার মধ্যে মান্দারন সরকারের অন্তর্গত ছিল মন্ডলঘাট পরগনা। অবশ্য আইন- ই- আকবরীতে বলা হয়েছে, প্রথমদিকে মন্ডলঘাট ছিল সরকার মান্দারনের একটি 'মহল' মাত্র, পরে পরগণায় রূপান্তরিত হয়। মুর্শিদকুলি খাঁর শাসনতান্রিক সংস্কারে ১০০ গ্রামে ১টি পরগণা হত। পরগণাগুলির মধ্যে মন্ডলঘাট ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ১৭০৩ সালের একটি পাইলট চার্টে দামোদর নদকে 'মন্ডলঘাট নদ' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।তার কারণ হয়তো মন্ডলঘাট পরগণার মধ্যে দিয়ে এই নদের নিম্নগতি প্রবাহ। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাম্রলিপ্ত বন্দরের সঙ্গে এই মন্ডলঘাট পরগনার আদান- প্রদান চলত। আইন-ই- আকবরী অনুসারে মন্ডলঘাট পরগনার রাজস্ব ছিল ৯,০৬,৭৭৫ দাম।
*********
তথ্য সূত্রঃ-
১. হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৭৬
২. পশ্চিমবাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য মন্দির মসজিদ - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৯৮
৩. হাওড়া জেলার ইতিহাস -২য় খন্ড - অচল ভট্টাচার্য, ১৯৮২
৪. Bengal District Gazetteer Howrah -L.S.S.Omalley,1909
৫. বাংলার মন্দির :স্থাপত্য ও ভাস্কর্য- প্রণব রায়, ১৯৯১
৬. হাওড়া জেলার ইতিহাস -হেমেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৯৯
৭. মানচিত্র সৌজন্যঃ গঙ্গা পথের ইতিকথা - অশোককুমার বসু
@অনুসন্ধানে - আশিস চক্রবর্তী ও অমলেন্দু বেরা
# প্রকাশিত - 'প্রতিদিনের গেরো' পাক্ষিক পত্রিকা ( ১লা নভেম্বর, ২০০৭)
No comments:
Post a Comment