হাওড়া জেলার দক্ষিণে শ্যামপুর থানার অন্তর্গত পুরুলপাড়া গ্রামের(২২.২৫ °উত্তর ৮৮.০০° পূর্ব) নামকরণ সম্পর্কে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, একসময় রূপনারায়ণ নদী সংলগ্ন এই গ্রামে ঝিঙ্গা ও ধুঁদুলের চাষ হত। ধুঁদুলের খোসা গায়ে সাবান মাখার কাজে ব্যবহৃত হয় যার স্থানীয় নাম 'পুরুল'। অনুমান করা হয়, এই পুরুলের আধিক্য হেতু গ্রামের নাম পুরুলপাড়া।
হাওড়া জেলার ইতিহাস পর্যালোচনায় জানতে পারি, দ্বাদশ শতকের ষষ্ঠ দশকে বর্ধমানের রাজা মন্ডলঘাট পরগনার জমিদারি পান। অনুমান করা হয়, সেন বংশের বিখ্যাত শাসক বল্লাল সেনের মহামান্ডলিক বর্তমান দাসপুর থানার(পশ্চিম মেদিনীপুর) মহিষঘাটা গ্রামের মহেশ মন্ডলের নাম অনুসারে মন্ডলঘাট পরগনার নামকরণ । পুরুলপাড়া গ্রামটি সেসময় মন্ডলঘাটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্ধমান রাজা পরগণার কিছু অংশ তাঁর কন্যাকে দান করেন এবং বাকী অংশ সাতক্ষীরার(বাংলাদেশ) চৌধুরীদের পত্তনি দেন। এই চৌধুরীদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ জমিদারি কিনে ফেলেন রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। পরবর্তীকালে তা মহিষাদলের রাজাদের কাছে হস্তান্তরিত হয়। ১২৫৮ বঙ্গাব্দে মতিলাল শীল মহিষাদলের রাজা লচমনগর্গের কাছ থেকে পুরুলপাড়া অংশটি কেনেন। প্রভাবশালী পত্তনিদার মতিলাল শীলের এই অংশের খাজনা আদায় করার জন্য গোমস্তা নিযুক্ত ছিলেন দক্ষিন দুর্গাপুর গ্রামের (শ্যামপুর থানা) ক্ষীরোদ বাগ। সেই সময় বর্তমান বাগনান থানার পিছনে মানকুর যাওয়ার পুরনো রাস্তার কাছে মতিলাল শীলের কাছারি বাড়ি ছিল।
১৩৩২ বঙ্গাব্দে এই গ্রামের একটি পুকুর খোঁড়ার সময় প্রায় ২০ ফুট নিচ থেকে দুটো কালো পাথরের থালা পাওয়া যায় যার একটি বর্তমানে এই গ্রামেরই প্রণব প্রামাণিকের বাড়িতে আছে। দেড় ইঞ্চি পলবিশিষ্ট থালাটির ব্যাস ১৮ ইঞ্চি।
এই অঞ্চলটি সহ প্রায় সম্পূর্ণ শ্যামপুর থানা খুব প্রাচীন জনপদ নয়।রূপনারায়ণ ও দামোদর নদে পলি জমতে জমতে নদীচর হিসেবে জেগে ওঠে। পরবর্তী কালে এখানকার জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা পরিষ্কার করে ধীরে ধীরে জনবসতি গড়ে ওঠে। প্রধাণত মেদিনীপুর জেলার কিছু মানুষ এখানে এসে বসবাস আরম্ভ করে। ক্রমশ গড়ে ওঠে নানা গ্রাম। সেজন্য শ্যামপুরের অনেক গ্রাম-নামের সঙ্গে মেদিনীপুরের অনেক গ্রাম-নামের মিল পাওয়া যায়। এই অঞ্চলটি একসময় নদীগর্ভে ছিল বলেই সাম্প্রতিক অতীতে পুকুর, কুয়ো ইত্যাদি খনন করতে গিয়ে কোথাও নৌকোর মাস্তুল কোথাও নৌকোর খোল ইত্যাদি পাওয়া গেছে। আনুমানিক ১০০ বছর আগে পুরুলপাড়া গ্রামের সমরেশ প্রমাণিকের পূর্বপুরুষ কৃষ্ণপদ প্রামানিকের পুকুর খুঁড়তে খুঁড়তে একটি নৌকার খোল ও মানুষের হাড় পাওয়া গিয়েছিল।
প্রায় দুশো বছরেরও কিছু আগে বর্ধমান থেকে আগত কৃষ্ণপদ মিত্রের পূর্বপুরুষ কুঁড়েরাম বোস স্থানীয় জঙ্গল থেকে একটি শিলা উদ্ধার করে বারাহি চন্ডী নামে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। এই চন্ডীমন্দিরের ২-৩ বছর পরে এখানকার শিব মন্দিরটি স্থাপিত হয়। পরে কুঁড়েরাম অষ্টধাতুর একটি রাধারমণ জিউ-এর মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করেন। আনুমানিক ৮০-৯০ বছর আগে প্রফুল্ল সামন্তের পিতামহ স্থানীয় একটি পুকুর থেকে একটি শিলা উদ্ধার করেন যা শীতলা দেবী রূপে বর্তমানে পূজিত হচ্ছে। তবে শীতলা মন্দিরে শীতলা দেবী ছাড়াও পঞ্চানন্দ, গঙ্গা, মনসা, ষষ্ঠী ও জ্বরাসুরের বর্ণময় সবাহন দারুবিগ্রহ রয়েছে যাদের নির্মাণশৈলী অনবদ্য।
তথ্য সূত্রঃ-
১. হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৭৬
২. পশ্চিমবাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য মন্দির মসজিদ - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৯৮
৩. হাওড়া জেলার ইতিহাস -২য় খন্ড - অচল ভট্টাচার্য, ১৯৮২
৪. বাংলার মন্দির :স্থাপত্য ও ভাস্কর্য- প্রণব রায়, ১৯৯১
৫. হাওড়া জেলার ইতিহাস -হেমেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,১৯৯৯
@অনুসন্ধানে - আশিস চক্রবর্তী ও অমলেন্দু বেরা
# প্রকাশিত - 'প্রতিদিনের গেরো ' পাক্ষিক পত্রিকা ( ১লা অক্টোবর, ২০০৭)
No comments:
Post a Comment