Tuesday, December 29, 2020

সপ্তম পর্বঃ পিছলদহ (Pichhaldaha)

হাওড়া জেলার দক্ষিণে শ্যামপুর থানার অন্তর্গত পিছলদহ গ্রামের (২২.২৫° উত্তর ,৮৮.০৩° পূর্ব)) নামকরণ সম্পর্কে স্থানীয় একটি জনশ্রুতি হল মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য পুরী থেকে পাণিহাটি যাওয়ার পথে এই স্থানে আড়াই দন্ড কাল(১ঘন্টা) বিশ্রাম নিয়েছিলেন এবং এখান দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর পা পিছলে যায়। সেই থেকেই এই গ্রামের নাম পিছলদহ। 'দহ' শব্দটি সংস্কৃত হ্রদ থেকে এসেছে যার অর্থ বিরাট জলাশয়।অর্থাৎ নদীতীরবর্তী এই ভূভাগের তীরভূমিতে পা পিছলে যাওয়া থেকেই ' পিছলদহ' নাম। এই ব্যাখ্যা কতটা গ্রহণযোগ্য তা ক্রমশঃ প্রকাশ্য। আগে দেখে নেওয়া যাক্ প্রাচীন মানচিত্রে এই স্থানটির কোনো উল্লেখ আছে কিনা।
দেখা যাচ্ছে, ১৫৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ডি- ব্যারোজ ও ১৫৬১ খ্রীস্টাব্দের গাস্টালডির মানচিত্রে বঙ্গোপসাগরের কাছে রূপনারায়ণ (?) ও দামোদরের(?) মধ্যবর্তী একটি স্থানকে যথাক্রমে 'পিসলতা'(Pisolta) এবং ' পিকলদা'(Picalda) নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। ও. ম্যালি ১৮৯২ সালে প্রকাশিত সি. আর. উইলসনের জার্নালের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে জানিয়েছেন -"Pisolta has been identified with the modern village of Pichhaldaha, close to Fort Mornington Point." এই 'ফোর্ট মর্নিংটন পয়েন্ট' হল ১৭৬৫-১৭৬৭ খ্রীষ্টাব্দে লর্ড ক্লাইভের দ্বারা নির্মিত একটি দুর্গ (বর্তমানে ভগ্নদশা) যা গাদিয়াড়া (হাওড়া) রূপনারায়ণ টুরিস্ট লজের সামনে নদীর পাড় থেকে ২৫ মিটার পূর্বে অবস্থান করছে। ও. ম্যালির বর্ণনা থেকে বর্তমান পিছলদহ গ্রামের পূর্ব নাম যে 'পিসলতা' বা ' পিকলদা' ছিল সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার আগে পাঠককে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগী হতে অনুরোধ করছি।সেটা হল চৈতন্য প্রসঙ্গ।


অন্যতম চৈতন্যজীবনীকার কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী আনুমানিক ১৬১৬ খ্রীস্টাব্দে রচিত শ্রীশ্রী চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের মধ্যলীলার ষোড়শ পরিচ্ছেদে 'পিচ্ছলদা' শব্দটি দু'বার ব্যবহার করেছেন। 'পিচ্ছলদা' শব্দটি 'পিছলদহ' শব্দের অপভ্রংশ হতে পারে। গ্রন্থে বলা হয়েছে --
১. পিচ্ছলদা পর্যন্ত সব তার অধিকার।
তার ভয়ে নদী কেহ হৈতে নারে পার।।
২. মন্ত্রেশ্বর দুষ্ট নদে পার করাইল।
পিচ্ছলদা পর্যন্ত সেই যবন আইল।।
চৈতন্যজীবন পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৫১৪ খ্রীষ্টাব্দের বিজয়াদশমীর দিন শ্রীচৈতন্য 'গৌড় দেশ দিয়া' বৃন্দাবনের উদ্দেশে যাওয়ার জন্য উড়িষ্যার পুরী থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। সেসময় বঙ্গদেশ থেকে পুরী যাতায়াতের যে তিনটি পথের উল্লেখ পাওয়া যায় সেগুলি হল --
ক) দক্ষিণ বঙ্গের যাত্রীদের জন্য -
আটিসারা ( বারুইপুর) > ছত্রভোগ > (জয়নগর -মজিলপুর) > তমলুক > নারায়ণগড় > দাঁতন > জলেশ্বর > ভদ্রক > পুরী
খ) মধ্যবঙ্গের যাত্রীদের জন্য -
পাণিহাটি > আন্দুল > সাঁকরাইল > নিমকির খাল ধরে বাগনান > কোলাঘাট > পাঁশকুড়া > রঘুনাথবাড়ি > পিছলদা > নারায়ণগড় > বেলদা > দাঁতন > সুবর্ণরেখা ধরে জলেশ্বর > রেমুণা >যাজপুর > কটক > ভুবনেশ্বর > পুরী
গ) উত্তর বঙ্গের যাত্রীদের জন্য -
বর্ধমান > হাজিপুর > মেদিনীপুর > হরিহরপুর > কেশপুর > নারায়নগড় > বালেশ্বর > নীলগড় > বৈতরণী >সাক্ষীগোপাল > পুরী
এই তিনটি পথের কোনোটি ছিল পায়ে হাঁটা, কোনোটি আবার নদীর আধিক্য থাকার কারণে ব্যয়বহুল। এজন্য সেসময় বঙ্গদেশে একটা প্রবাদ প্রচলিত ছিল --
"হাতে কড়ি পায়ে বল
তবে যাবি নীলাচল।"
এখন প্রশ্ন, চৈতন্য সেবার পুরী থেকে পাণিহাটি গিয়েছিলেন কোন্ পথে?
চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে দ্বিতীয় পথটির কিছু কিছু স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ পথেই পিছলদার (পিছলদহ) অবস্থান। কবিরাজ গোস্বামী জানিয়েছেন, মন্ত্রেশ্বর নদের একদিকে ওড্রদেশ( উড়িষ্যা) তথা প্রতাপরুদ্রের (১৪৯৭-১৫৪০ খ্রীষ্টাব্দ) সীমা, আর একদিকে 'পিচ্ছলদা' অর্থাৎ যবনরাজ্য শুরু (বাংলা) যার সর্বময় কর্তা আলাউদ্দীন হুসেনশাহ( ১৪৯৩-১৫১৯ খ্রী.)।
চৈতন্যের গৌড় যাত্রাকালে বাংলার সঙ্গে উড়িষ্যার সম্পর্ক মধুর ছিল না। যোগেশচন্দ্র বসু লিখেছেন -" শ্রীচৈতন্য যে সময় উড়িষ্যায় গমন করেন,সে সময় উৎকলের হিন্দু রাজার সহিত বাঙ্গালার মুসলমান সুলতানের বিবাদ চলিতেছিল।" ১৫০৯ খ্রীস্টাব্দের শেষ দিকে হুসেন শাহের সেনাপতি ইসমাইল গাজী উড়িষ্যা আক্রমণ করে কিছু অঞ্চল দখল করে নেন কিন্তু প্রতাপরুদ্র শেষপর্যন্ত অধিগৃহীত এলাকা পুনরুদ্ধার করে বঙ্গের হুগলী নদী (গড় মান্দারণ) পর্যন্ত সীমানা বিস্তার করেছিলেন। তবে প্রধান কর্মচারী গোবিন্দ বিদ্যাধরের ষড়যন্ত্র ও হুসেন শাহের বারবার আক্রমণের ফলে প্রতাপরুদ্রের শাসনের পূর্ব সীমা কিছুটা সংকুচিত হয়ে পড়ে।
১৫১৪ খ্রীস্টাব্দে এই পরিস্থিতি ছিল ভয়ানক।সেই কারণে রাজা প্রতাপরুদ্র ও রায় রামানন্দ (রাজা প্রতাপরুদ্রের অধীনস্থ গোদাবরী তীরবর্তী বিদ্যানগরের শাসনকর্তা) চৈতন্যের গৌড় যাত্রা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলেন।পূর্বেই বলা হয়েছে পুরী থেকে গৌড়ে যাবার পথ ছিল তিনটি। শিশির কুমার ঘোষ জানিয়েছেন," সেইসময় এমন যুদ্ধ বাঁধিয়া উঠিয়াছে যে, এই তিন পথই বন্ধ।" জীবনীকারদের বিবরণ অনুযায়ী চৈতন্য অনেক লোকজন নিয়ে পুরী থেকে যাত্রা করে ভুবনেশ্বর, কটক, যাজপুর, রেমুনা হয়ে উড়িষ্যা সীমানা মন্ত্রেশ্বর উপকূলে উপস্থিত হন। বিতর্কের শুরু এই মন্ত্রেশ্বর নদের তীরের একটি ভূখন্ডকে ঘিরে। সমনামে হাওড়া (পিছলদহ) ও পূর্ব মেদিনীপুর (পিছলদা) জেলায় দুটি স্থান রয়েছে এবং দুটি স্থানেই মহাপ্রভুর বিগ্রহ ও মন্দির বিদ্যমান।



অনেকে মনে করেন, এই উড়িষ্যা সীমানা বলতে তমলুক বা তার নিকটবর্তী কোনো অঞ্চলকে বোঝানো হয়েছে এবং মন্ত্রেশ্বর নদ বর্তমান রূপনারায়ণের পূর্ব নাম। পিচ্ছলদা হল বর্তমান হাওড়া জেলার দক্ষিণে শ্যামপুর থানার অন্তর্গত পিছলদহ গ্রাম। কবিরাজ গোস্বামীর বিবরণের প্রেক্ষিতে তাঁদের যুক্তি, পুরী থেকে উড়িষ্যা সীমায় অর্থাৎ তমলুকে পৌঁছানোর পর সেখানকার 'রাজ-অধিকারী' (ভূমিরক্ষক বা প্রশাসক) শ্রীচৈতন্যকে 'দিন দুই চারি ' সেখানে বিশ্রাম নেবার পরামর্শ দেন যাতে তিনি নদীর ওপারের অর্থাৎ বাংলার সীমার (পিছলদহ) 'মদ্যপ যবন' প্রশাসকের সঙ্গে 'সন্ধি' করে নিরাপদে নদী পেরিয়ে মহাপ্রভুর ' সুখেতে' পাণিহাটি যাত্রার ব্যবস্থা করতে পারেন। এদিকে 'জগন্নাথ হৈতে 'আগত' এক সন্ন্যাসী'র আগমণের খবর পেয়ে সেই যবন প্রশাসক তাঁর এক চরকে হিন্দুর ছদ্মবেশে উড়িষ্যা সীমান্তে সবিস্তারে খবর নিতে পাঠান এবং সেই চর ফিরে গিয়ে তাঁকে সকল বৃত্তান্ত জানান। তিনি সেই বর্ণনা শুনে ভাববিগলিত হয়ে পড়েন এবং নিজে উড়িষ্যা সীমানায় পৌঁছে চৈতন্যের শ্রী চরণে প্রণাম জানিয়ে পরম ভক্তে রূপান্তরিত হন। তিনিই মহাপ্রভুর নির্বিঘ্নে বাংলায় যাত্রার সুবন্দোবস্ত করে দেন। জলদস্যুর হানা প্রতিরোধের নিমিত্তে দশ নৌকা ভর্তি সৈন্য নিয়ে চৈতন্য ও তাঁর লোকজনদের একটি 'নবীন নৌকা'য় ( সুরম্য) চাপিয়ে তমলুক থেকে মন্ত্রেশ্বর পার হয়ে পিছলদহে নিয়ে আসেন। তারপর সেই যবন নিজ স্থানে অর্থাৎ পিছলদহে থেকে যান এবং আড়াই দন্ড বিশ্রাম নিয়ে মহাপ্রভু হুগলি নদী পথে বেতড় , কলকাতা, শুকচর অতিক্রম করে সপার্ষদ পাণিহাটিতে পৌঁছান।শ্যামপুর থানার পিছলদহে প্রাচীন বট, অশ্বত্থ ও তমাল বৃক্ষ সংলগ্ন এলাকাকে স্থানীয় মানুষজন চৈতন্য পাদস্পর্শিত পবিত্র ভূমি বলে মনে করেন।
এবার সমকালীন ইতিহাসের আলোকে উপরোক্ত দৃষ্টিকোণ পর্যালোচনা করে দেখা যাক্।
বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী মন্ত্রেশ্বর নদের উল্লেখ শুধু চৈতন্যচরিতামৃত নয়, জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল, কবি কর্ণপুরের চৈতন্যচন্দ্রোদয়, গোবিন্দদাসের কড়চা, কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল সহ অষ্টাদশ শতকের একাধিক বৈষ্ণব শ্রীপাট বিবরণীতে পাওয়া যায়। যদিও ষোড়শ শতকের কোনো মানচিত্রে (ডি-ব্যারোজ ১৫৫৩, গাস্টালডি -১৫৬১,হন্ডিভ্স-১৬১৪, ক্যান্টেলি দ্য ভিগনোলা-১৬৮৩, ভ্যান ডেন ব্রুক-১৬৬০, জি. ডেলিসলে-১৭২০, ইজাক টিরিঅন-১৭৩০, এফ. ডে উইট-১৭২৬, রেনেল-১৭৬৪) এই নামের কোনো নদীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না । এবার রূপনারায়ণের প্রসঙ্গে আসা যাক্। বিভিন্ন সময়ের মানচিত্রকর ভিন্ন ভিন্ন নামে রূপনারায়ণকে চিহ্নিত করেছেন, যেমন গঙ্গা (ডি-ব্যারোজ এবং গাস্টালডি), গুয়েঙ্গা ( ব্লেভ), তাম্বোলি(টমাস বাউরি), তোম্বারলি(পাইলট চার্ট), পাত্র ঘাটা(ভ্যালেনটিন), রেনেল( রূপনারায়ণ)। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কেউই 'মন্ত্রেশ্বর' শব্দটি ব্যাবহার করেন নি। এর কারণ হতে পারে মন্ত্রেশ্বর তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো নদ নয় বা দৈর্ঘ্য প্রস্থের বিচারে তার প্রবাহ এত নগণ্য যে আলাদা করে উল্লেখ করার দাবি রাখে না।


জলদস্যুর প্রসঙ্গটি ইতিহাসসম্মত। 'মেদিনীপুরের ইতিহাস' গ্রন্থে বলা হয়েছে - "....নদী পার হওয়া বড়ই দুঃসাধ্য ছিল। ... জলপথ জলদস্যুসমাকুল ছিল।" চৈতন্যচরিতামৃতে এজন্য 'মন্ত্রেশ্বর দুষ্ট নদ' বলা হয়েছে। তবে শুধু মন্ত্রেশ্বর নয় সেসময়ের অনেক নদ নদীতেই জলদস্যুরা হঠাৎ হঠাৎ আক্রমণ করে লুঠপাট চালাত। এমনকি বঙ্গোপসাগর থেকে সংকীর্ণ নদীপথে অনেকটা ভিতরে গিয়েও আক্রমণ, হত্যা ও লুন্ঠন চালাত বলে বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ আছে।
উপরোক্ত মতাবলম্বীরা উড়িষ্যার সীমা হিসেবে যে তমলুকের কথা বলেছেন তা যথাযথ বলে মনে হয় না। কারণ পুরী মন্দিরে সংরক্ষিত তালপাতায় হস্তলিখিত মাদলাপঞ্জীর বিবরণ অনুযায়ী সেসময় উড়িষ্যা বা উৎকলদেশ যে ৩১ টি দন্ডপাঠে বিভক্ত ছিল তার মধ্যে ৬ টি দন্ডপাঠ বর্তমান মেদিনীপুর জেলার (অখন্ড) অন্তর্ভুক্ত। যথা- (১) টানিয়া, (২) জৌলিতি, (৩) নারায়ণপুর, (৪) নইগাঁ, (৫) মালঝিটা, (৬) ভঞ্জভূম-বারিপাদা। এই দন্ডপাঠগুলি যেসব এলাকা বা অঞ্চলকে নির্দিষ্ট করত তাদের মধ্যে তমলুকের উল্লেখ নেই। যোগেশচন্দ্র বসু লিখেছেন - "তৎকালে তাম্রলিপ্ত একটি স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল; উহা উড়িষ্যার অন্তর্গত ছিল না। তাম্রলিপ্তের দক্ষিণ হইতেই উড়িষ্যার সীমা আরম্ভ হইয়াছিল।" চৈতন্যচরিতামৃতে 'ওড্রদেশসীমা'য় যে রাজ অধিকারীর কথা বলা হয়েছে তিনি উৎকলরাজ প্রতাপরুদ্রের অধীন একজন প্রশাসক।

তাহলে স্থানটি তমলুক নয়।কেননা চৈতন্য মাত্র একবারই তমলুকে পদার্পণ করেছিলেন বলে ( ১৫১০ খ্রীস্টাব্দে প্রথমবার ছত্রভোগ হয়ে পুরী যাত্রার সময়) জীবনীকাররা উল্লেখ করেছেন। তমাল বৃক্ষের নিচে আড়াই দন্ড বিশ্রাম নেওয়ার প্রসঙ্গটি কোনো জীবনী গ্রন্থে নেই।
এবার আসা যাক্ 'ওড্রদেশ সীমা'য় সেই রাজ অধিকারীর প্রসঙ্গে। তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় 'শ্রীচৈতন্যের পুরী যাত্রাপথ' শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন যে সেই অধিকারী হলেন গোপীনাথ পট্টনায়ক । আনুমানিক ১৫৭২ খ্রীস্টাব্দে রচিত কবি কর্ণপুরের সংস্কৃত নাটক 'চৈতন্যচন্দ্রোদয়' ও অন্যান্য চৈতন্যজীবনী অনুসরণে শিশির কুমার ঘোষ যে 'অমিয় নিমাইচরিত' গ্রন্থ রচনা করেছেন তাতে বলা হয়েছে, পিচ্ছলদার যবন সীমারক্ষক যখন চৈতন্য ভক্তে রূপান্তরিত হলেন ''তখন গোপীনাথ বলিতেছেন, 'ওহে অধিকারি, প্রভূ গণসহ গৌড়ে যাইবেন, তুমি তাঁহার সহায়তা কর।"এই গোপীনাথ পট্টনায়ক কে? যোগেশচন্দ্র বসু তাঁর 'মেদিনীপুরের ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন-" ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম পাদে চৈতন্যদেবের প্রিয়শিষ্য রামানন্দ রায়ের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গোপীনাথ পট্টনায়ক মালঝিটা দন্ডপাঠে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।" বর্তমানের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি, রামনগর, খেজুরী ও ভগবানপুর থানাধীন এলাকা নিয়ে গঠিত ছিল সেকালের মালঝিটা দন্ডপাঠ। অর্থাৎ এই মালঝিটা দন্ডপাঠ অধীন এলাকার প্রান্ত দিয়ে বয়ে যেত মন্ত্রেশ্বর। এই অঞ্চলের ক্ষেত্রসমীক্ষা করে তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় আরও জানিয়েছেন - "প্রাচীন পথ দেখে মনে হয় কংসাবতী থেকে মন্ত্রেশ্বর উৎপন্ন হয়ে পিছলদার (পূর্ব মেদিনীপুর) পশ্চিমপ্রান্ত দিয়ে কিছুটা অগ্রসর হয়ে (বর্তমানে রসুলপুর নদী) সমুদ্রে প্রবেশ করত। "ড. এস. কে. অয়নগর তাঁর 'Cambridge History of India' গ্রন্থেও মন্ত্রেশ্বর নদের এমন অবস্থান অনুমান করেছেন। মনে হয় মন্ত্রেশ্বর নদী কংসাবতী থেকে উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণে অগ্রসর হয়েছিল সমুদ্রের দিকে। এ অনুমান অমুলক নয়। কারণ মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কবি রামচন্দ্রের লেখা একটি প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথি আবিষ্কার করেছিলেন। তাতে তাম্রলিপ্তের রাজা গোপীচন্দ্রের নাম পাওয়া যায়। সেই পুঁথিতে উল্লিখিত গোপীচন্দ্রের কাহিনী যোগেশচন্দ্র বসুর ভাষায় - "গোপীচন্দ্র ছত্রেশ্বরী দেবীর সম্মুখে ক্রোধে অধীর হইয়া এক ব্রাহ্মণের শিরশ্ছেদ করায় দেবী অধোমুখী হইয়া থাকেন। কিছুদিন পরে গোপীচন্দ্র পাঙ্গাভূমিতে গিয়া গঙ্গাসাগরের স্রোতে মন্ত্রেশ্বরের কাছে জলে ডুবিয়া যান।" এই বর্ণনা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় মন্ত্রেশ্বরের ধারা সাগরদ্বীপের নিকটবর্তী জলপ্রবাহে গিয়ে মিশত। সেদিক থেকে রূপনারায়ণের সঙ্গে তার দূরত্ব অনেক।
সেকালে সম্ভবত পিছলদার পাশ দিয়ে একটি ধারা রঘুনাথবাড়ি হয়ে পাঁশকুড়া পর্যন্ত ছিল যে পথে চৈতন্য পাঁশকুড়ায় পৌঁছেছিলেন।ষোড়শ শতকের প্রথমদিকে এই নদ প্রসস্থ ছিল না বলেই মনে হয়। কারণ সমকালের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে লিখেছেন - "বুড়া মন্ত্রেশ্বর বায় বানিয়ার বালা"। রামকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর গবেষণামূলক 'ধনপতির সিংহলযাত্রা' উপন্যাসের 'নদ-নদীর মগরা গমন' (২৭) শীর্ষক পরিচ্ছেদে সহমত পোষণ করে মন্ত্রেশ্বর ও রূপনারায়ণকে পৃথক দুটি নদী হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
পিছলদার পার্শ্ববর্তী ডিহি কাশিমপুরে প্রাচীন একটি গৌরমূর্তি আছে যার কথা নবদ্বীপবাসী হরিদাস দাস তাঁর 'মধ্যযুগীয় গৌড়ীয় সাহিত্যের ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক অভিধান' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। রঘুনাথবাড়ি ও পাঁশকুঁড়ার মন্দিরে মহাপ্রভুর প্রাচীন বিগ্রহ চৈতন্যের যাত্রাপথের স্মৃতি নিয়ে আজও বিরাজমান।
এবার আসা যাক পাণিহাটি পর্যন্ত বাকি পথপরিক্রমা প্রসঙ্গে ।জগদীশ চক্রবর্তী তাঁর 'তাম্রলিপ্ত তমলুক থেকে দূরে' প্রবন্ধে ভাগীরথীর বেতড়- উলুবেড়িয়া - পাঁশকুড়া - পিংলা ও নারায়ণগড় গামী লুপ্ত খাতের কথা বলেছেন। বিপ্রদাস পিপলাই-এর মনসামঙ্গল ও কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে বর্ণিত গঙ্গার গতিধারার সঙ্গে এই ধারণার মিল রয়েছে । মুকুন্দরাম চণ্ডীমঙ্গলে লিখেছেন, শ্রীমন্ত সদাগরের নৌকা কলকাতা ও বেতড় পার হয়ে কালিকট যাবার সময় "ডাহিনে ছাড়িয়া যায় হিজলির পথ।" আবার হরিদাস দাস তাঁর 'বৈষ্ণব তীর্থ' গ্রন্থে এই জলপথের কথা সমর্থন করে জানিয়েছেন যে চৈতন্যদেবের সময়ে বেতড়ের একটু দক্ষিণ থেকে গঙ্গা বা ভাগীরথীর একটি শাখা পশ্চিমবাহিনী হয়ে আন্দুলের ওপর দিয়ে উলুবেড়িয়া, বাগনান হয়ে প্রবাহিত হত। 'বদর শাহের চড়' নামে অধিক পরিচিত এই পথ দিয়ে পর্তুগীজ নাবিকরা লবনের ব্যবসা করত। যদিও এই জলপথের স্থানীয় নাম ছিল 'নিমকির খাল '। পরবর্তীকালে কেউ কেউ একে 'কাটি গঙ্গা'ও বলেছেন। তাঁদের ধারণা গঙ্গাকে সরল পথে চালনার জন্য ইংরেজরা এই পথটি কেটেছিলেন। কিন্তু তা একেবারেই সত্যি নয়। এটি ভাগীরথীর প্রাচীন খাত। চৈতন্যপার্ষদ নিত্যানন্দ যে এই পথেই সাঁকরাইল থেকে আন্দুলে কৃষ্ণানন্দ চৌধুরীর অতিথি হয়েছিলেন তা জীবনীগ্রন্থ থেকে জানা যায়। যোগেশচন্দ্র বসু লিখেছেন - "এই পথ দিয়া অতি অল্প দিনেই উড়িষ্যায় যাওয়া যাইত।" শ্রীচৈতন্য যে একদিনেই পিছলদা থেকে পাণিহাটিতে রাঘব পন্ডিতের বাড়ি পৌঁছেছিলেন সেকথা জীবনীগ্রন্থে উল্লেখ করা আছে।
বিনয় ঘোষ রচিত ' পশ্চিম বঙ্গের সংস্কৃতি' গ্রন্থের সৌজন্যে প্রাপ্ত ষোড়শ -সপ্তদশ শতকের একটি মানচিত্রে পিছলদহ স্থানটিকে তমলুকের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের নিকটে চিহ্নিত করা হয়েছে যা স্পষ্টতই পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত । হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর একটি অভিভাষণে জানিয়েছেন "খ্রীষ্টের জন্মের চৌদ্দ শত কি পনর শত বৎসর পরে যেসকল মনসার ও চন্ডীর গান পাওয়া যায়, তাহাতে তমলুকের নাম নাই। সেসময় লোকে পিছলদা ও ছত্রভোগ হইয়া সমুদ্রে যাইত।" এই ছত্রভোগ বর্তমান জয়নগর- মজিলপুর (দক্ষিন ২৪ পরগণা) থেকে ৬ কিমি. দক্ষিণে অবস্থিত ছিল।

ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বিচার করলে শ্যামপুর অঞ্চলটি খুব প্রাচীন বলে মনে হয় না। নিকটবর্তী এলাকায় যে সব স্থাপত্যের সন্ধান পাওয়া গেছে তা অষ্টাদশ বা তার পরবর্তী কালের।সমগ্র অঞ্চলটি যে একদা নদীগর্ভে ছিল তার প্রমান বিভিন্ন সময়ে খননে প্রাপ্ত নৌকার খোল বা মাস্তুলের অংশবিশেষ থেকে পাওয়া যায়। পরে চর হিসেবে জেগে ওঠে ও অরণ্যসমাকীর্ণ হয়ে পড়ে।প্রবীণ ব্যক্তিদের বক্তব্যেও তা স্পষ্ট। তারপর মূলতঃ মেদিনীপুর থেকে বাসিন্দারা এই জেগে ওঠা চরভূমিতে এসে জঙ্গল পরিষ্কার করে বসবাস শুরু করে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে জনপদ। এজন্য এ অঞ্চলের অনেক গ্রামের নামের সঙ্গে মেদিনীপুরের গ্রামনামের মিল পাওয়া যায়। যেমন- ভগবানপুর, কমলপুর, বরদাবাড়, শ্যামপুর, রাধাপুর, কামদেবপুর, চাউলখোলা ইত্যাদি।
সেদিক থেকে বিচার করলে পূর্ব মেদিনীপুর জেলাধীন পিছলদা সহ সমগ্র ভগবানপুর থানা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা যথেষ্ট প্রাচীন। স্থানীয় স্থাপত্য ও বনেদী পরিবারের কুলপরিচয়ের পরম্পরা বিচার করলেও তার প্রমান মেলে।
তথ্য, ঐতিহাসিক প্রমাণ ও যুক্তির পারম্পর্য নিরপেক্ষ ভাবে পর্যালোচনার পরেও পিছলদহে শ্রীচেতন্য প্রসঙ্গটির সিদ্ধান্ত টানা সম্ভব নয়।কারন সেকাল- একালের পারস্পরিক আলোচনায় এখনও কিছু প্রশ্ন অমীমাংশিত থেকে গেল। সেগুলি এবার দেখে নেওয়া যাক্----
ক) তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় যে উড়িষ্যার সীমারক্ষকের কথা বলেছেন তিনি মালঝিটা দন্ডপাঠের গোপীনাথ পট্টনায়ক নাও হতে পারেন।চৈতন্যচরিতামৃতে তাঁর নামের উল্লেখ নেই। আবার শিশির কুমার ঘোষ গোপীনাথের যে উক্তি তুলে ধরেছেন, কবিরাজ গোস্বামীর কাব্যে সেই উক্তির বক্তা মুকুন্দ দত্ত। জীবনীকার লিখেছেন-
তবে মুকুন্দ দত্ত কহে শুন মহাশয়।
গঙ্গাতীরে যাইতে মহাপ্রভুর মন হয়।।
তাহা যাইতে কর তুমি সহায় প্রকার।
এই বড় আজ্ঞা এই বড় উপকার।।

আবার, চৈতন্যের সঙ্গী হিসেবে যাঁরা সেদিন পুরী থেকে গৌড়ে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন মহাপ্রভুর একান্ত ভক্ত গোপীনাথ আচার্যও। তাই প্রশ্ন থাকবেই উক্তিটির বক্তা সেই গোপীনাথ আচার্য নন তো?
খ) মাদলা পঞ্জীর বিবরণ অনুযায়ী, তাম্রলিপ্ত স্বশাসিত ছিল,উড়িষ্যা রাজ্যের দন্ডপাঠগুলির অন্তর্ভুক্ত ছিল না। আসলে অনঙ্গভীমদেবের সময় থেকে মুকুন্দদেবের রাজত্বকাল পর্যন্ত (১১৭৫-১৫৬৯ খ্রী.) উড়িষ্যার গঙ্গ বংশীয় রাজারা তমলুকের তদানীন্তন রাজবংশকে উৎখাত না করে তাঁদের সামন্ত রূপে রাজত্ব করার সুযোগ দেন। সেদিক থেকে বিচার করলে তমলুকও উড়িষ্যা রাজ্যেরই সীমা, নয় কি?
গ) শ্যামপুর থানার পিছলদহ গ্রামের মহাপ্রভু আশ্রমের উত্তরদিকে তমাল বৃক্ষ থেকে প্রায় ১৫ ফুট দূরে দেড় ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট একটি টেরাকোটার (পোড়ামাটির) মুন্ড রাঢ় অঞ্চলের লৌকিক দেবতা দক্ষিণ রায় হিসেবে খোলা জায়গায় পুজিত হন। অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষে এই দেবতার বার্ষিক উৎসব হয়। দক্ষিণরায় অরণ্য ও বাঘের দেবতা।স্থানটি যে একদা অরণ্যসমাকীর্ণ ও ব্যাঘ্রসংকুল ছিল তা এ থেকেই বোঝা যায়। একসময় মাটি খনন করতে গিয়ে এটি পাওয়া গেছে বলে প্রবীনদের মত। আবার এই গ্রামেরই মুখোপাধ্যায় পরিবারে সম্ভবত মস্তকবিহীন প্রাচীন এক নৃসিংহমূর্তি বারাহীচন্ডী হিসেবে পূজিত হন। সেটিও পুকুর খননের সময় উদ্ভুত। ভাস্কর্যশৈলীর নিরিখে এটি দ্বাদশ শতাব্দীর পাল যুগের বলে অনুমান।প্রাচীন মূর্তির পিছনে বর্তমানে সিংহবাহনে আসীন চতুর্ভূজা বর্ণময় সুসজ্জিত চন্ডীমূর্তি নির্মাণ করা হয়েছে। দেবীর ডানদিকে কৃষ্ণ বর্ণের প্রায় ৩ ফুট দৈর্ঘ্য,১ ফুট প্রস্থ ও দেড় ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট আয়তাকার একটি প্রস্তরখন্ড রয়েছে। মনে হয় এটি কোনো স্থাপত্যের অংশ। তাছাড়া গ্রামে বিভিন্ন সময় পুকুর, কুয়া ইত্যাদি খনন করতে গিয়ে পুরানো খোলামকুচি, মৃৎপাত্র, মটির তৈজস ইত্যাদি পাওয়া গিয়েছে একাধিকবার। হাওড়া জেলা গবেষক তারাপদ সাঁতরা বলেছেন - "এখানে উৎখনন চালালে আরও প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের সম্ভাবনা আছে।" তাই প্রশ্ন হল এই টেরাকোটার মুখ, প্রস্তর মূর্তি বা স্থাপত্যের অংশ কি এ অঞ্চলে প্রাচীন কোনো জনপদের ইঙ্গিত বহন করছে?





রূপনারায়ণের প্রাচীন গতিপথ ও আজকের গতিপথের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে যথেষ্ট। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়,দ্বারকেশ্বর ও শিলাবতীর মিলিত প্রবাহে সৃষ্ট এই নদ একসময় বাগনান - খালোড় - বাঁটুল - মুগকল্যান - হরিনারায়ণপুর - হাল্যান - কাঁটাগাছি - প্রতাপপুর - আমড়দহ- দানপেতিয়া - বাছরি- বৈঁচি - নারায়ণপুর- - কোটরা - কালীদহ - পিছলদহ - ইত্যাদি এলাকার উপর দিয়ে প্রবাহিত হত। বর্তমানে তা প্রায় ছয়- সাত কি.মি. পশ্চিম দিকে সরে গেছে। এইকারণে ঐসব এলাকা থেকে আকশ্মিকভাবে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রত্নবস্তু খুঁজে পাওয়া গেছে। যেমন- সামতাবেড়িয়া (বিষ্ণু-বাসুদেব মূর্তি), খালোড়( বিষ্ণুমূর্তি), বাগনান-হরিনারায়ণপুর(বাসুদেবমূর্তি, মহিষমর্দিনী মূর্তি), বাছরি(বিষ্ণুমূর্তি, বিষ্ণুপট্ট), শ্যামপুর হরিনারায়ণপুর (বৌদ্ধ তারা মূর্তি), আমবেড়ে(দক্ষিণ রায়ের শিলা পিতলের কৌটায় যা বৌদ্ধ চৈতের ক্ষুদ্র সংস্করণ), দেউলি( বিষ্ণুমূর্তি), নুনেবাড়(বিষ্ণুমূর্তি), রাধাপুর(রোমান রণদেবতা জানুস-এর মূর্তি), পিছলদহ( নৃসিংহমূর্তি ও টেরাকোটার মুন্ড)। হিউএন সাং- এর বিবরণ অনুযায়ী, প্রাচীন তাম্রলিপ্ত রাজ্যটির আয়তন ছিল ১৪০০-১৫০০ লি। কানিংহামের মতে ৬ লিতে ১ মাইল হয়। অর্থাৎ প্রায় ৪০০ কি. মি. বিস্তৃত ছিল সেই বাণিজ্য নগরী। প্রাজ্ঞ ক্ষেত্রসমীক্ষক শিবেন্দু মান্নার মতে "সুপ্রাচীন তাম্রলিপ্ত সভ্যতা ও সংস্কৃতি বলয়ের মধ্যে বর্তমান কালের শ্যামপুর ও বাগনান এলাকার অন্তর্ভুক্তি সুনিশ্চিত।"
নদী কিংবা ইতিহাস এখনও নিরুত্তর। বিস্রস্ত চিহ্নের সূত্র এখনও অনায়ত্ত। চৈতন্য জন্মভূমির মতো চৈতন্য পাদস্পর্শে পুণ্যভূমি পিছলদহ এখনও অধরা। কিংবদন্তী আর ইতিহাসের সমন্বয়ে কবে মিলবে সেই খোঁজ, জানা নেই। তাই সুদূর অতীতের সেই ধূসর পান্ডুলিপির হরফ উদ্ধারে অনুসন্ধান চলতে থাকবে।
***********
তথ্য সূত্রঃ-
১. চৈতন্যচরিতামৃত - কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী ( সম্পা.-উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়), ১৯৮৬
২. চৈতন্য ভাগবত- বৃন্দাবন দাস( সম্পা.- কাঞ্চন বসু),১৯৮৩
৩.চণ্ডীমঙ্গল - কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ( সম্পা.- সুকুমার সেন),২০০৭
৪. বাইশা- (সম্পা.- আশুতোষ ভট্টাচার্য), ১৯৫৪
৫. শ্রী গৌড়ীয় পত্রিকা - ৭ বর্ষ,৪২ সংখ্যা,১৯২৯
৬. শ্রী শ্রী গৌড়ীয় বৈষ্ণব তীর্থ - হরিদাস দাস
৭. অমিয় নিমাই চরিত - শিশির কুমার ঘোষ,১৯৮৯
৮. মেদিনীপুরের ইতিহাস - যোগেশচন্দ্র বসু, ১৯৭৮
৯. বাঙালীর ইতিহাস (আদি পর্ব)- নীহাররঞ্জন রায়,১৯৮০
১০. হাওড়া শহরের ইতিবৃত্ত ( ১ম খন্ড) - অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়,১৯৯৪
১১. গঙ্গা পথের ইতিকথা - অশোক কুমার বসু, ১৯৮৯
১২. বাংলার হারানো নদীর ইতিকথা - প্রীতিতোষ রায়, ২০১২
১৩. বাংলাদেশের নদ-নদী ও পরিকল্পনা - কপিল ভট্টাচার্য, ১৯৫৪
১৪. পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি - বিনয় ঘোষ, ১৯৯২
১৫. তমলুকের ইতিহাস - প্রদ্যোৎ কুমার মাইতি,২০১৫
১৬. হাওড়া ইতিহাস ও ঐতিহ্য - শিবেন্দু মান্না, ২০১১
১৭. হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৭৬
১৮. পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা ( মেদিনীপুর জেলা সংখ্যা), জানুয়ারি ২০০৪
১৯. সপ্তডিঙা পত্রিকা ( কালীপুজো সংখ্যা),১৪২৬
২০. সমকালীন পত্রিকা - কার্তিক, ১৩৮৮
২১. Bengal District Gazetteer Howrah - L.S.S Omalley,1909
২২. West Bengal District Gazetteers Howrah -Amiya Kumar Banerji, 1972
২৩. Journal of the Asiatic Society of Bengal- C.R.Wilson,1892
২৪. Cambridge History of India( vol-3)- Dr. S.K. Ayangar
মানচিত্র সূচিঃ-
১. ডি. ব্যারোজ - ১৫৫৩
২. ভ্যান ডেন ব্রুক- ১৬৬০
৩. রেনেল- ১৭৮২
৪. পশ্চিমবঙ্গের নদ-নদী(ষোড়শ -সপ্তদশ শতাব্দী)

Sunday, December 13, 2020

ষষ্ঠ পর্বঃ পুরুলপাড়া (Purulpara)

হাওড়া জেলার দক্ষিণে শ্যামপুর থানার অন্তর্গত পুরুলপাড়া গ্রামের(২২.২৫ °উত্তর ৮৮.০০° পূর্ব) নামকরণ সম্পর্কে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, একসময় রূপনারায়ণ নদী সংলগ্ন এই গ্রামে ঝিঙ্গা ও ধুঁদুলের চাষ হত। ধুঁদুলের খোসা গায়ে সাবান মাখার কাজে ব্যবহৃত হয় যার স্থানীয় নাম 'পুরুল'। অনুমান করা হয়, এই পুরুলের আধিক্য হেতু গ্রামের নাম পুরুলপাড়া।

হাওড়া জেলার ইতিহাস পর্যালোচনায় জানতে পারি, দ্বাদশ শতকের ষষ্ঠ দশকে বর্ধমানের রাজা মন্ডলঘাট পরগনার জমিদারি পান। অনুমান করা হয়, সেন বংশের বিখ্যাত শাসক বল্লাল সেনের মহামান্ডলিক বর্তমান দাসপুর থানার(পশ্চিম মেদিনীপুর) মহিষঘাটা গ্রামের মহেশ মন্ডলের নাম অনুসারে মন্ডলঘাট পরগনার নামকরণ । পুরুলপাড়া গ্রামটি সেসময় মন্ডলঘাটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্ধমান রাজা পরগণার কিছু অংশ তাঁর কন্যাকে দান করেন এবং বাকী অংশ সাতক্ষীরার(বাংলাদেশ) চৌধুরীদের পত্তনি দেন। এই চৌধুরীদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ জমিদারি কিনে ফেলেন রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। পরবর্তীকালে তা মহিষাদলের রাজাদের কাছে হস্তান্তরিত হয়। ১২৫৮ বঙ্গাব্দে মতিলাল শীল মহিষাদলের রাজা লচমনগর্গের কাছ থেকে পুরুলপাড়া অংশটি কেনেন। প্রভাবশালী পত্তনিদার মতিলাল শীলের এই অংশের খাজনা আদায় করার জন্য গোমস্তা নিযুক্ত ছিলেন দক্ষিন দুর্গাপুর গ্রামের (শ্যামপুর থানা) ক্ষীরোদ বাগ। সেই সময় বর্তমান বাগনান থানার পিছনে মানকুর যাওয়ার পুরনো রাস্তার কাছে মতিলাল শীলের কাছারি বাড়ি ছিল।
১৩৩২ বঙ্গাব্দে এই গ্রামের একটি পুকুর খোঁড়ার সময় প্রায় ২০ ফুট নিচ থেকে দুটো কালো পাথরের থালা পাওয়া যায় যার একটি বর্তমানে এই গ্রামেরই প্রণব প্রামাণিকের বাড়িতে আছে। দেড় ইঞ্চি পলবিশিষ্ট থালাটির ব্যাস ১৮ ইঞ্চি।

এই অঞ্চলটি সহ প্রায় সম্পূর্ণ শ্যামপুর থানা খুব প্রাচীন জনপদ নয়।রূপনারায়ণ ও দামোদর নদে পলি জমতে জমতে নদীচর হিসেবে জেগে ওঠে। পরবর্তী কালে এখানকার জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা পরিষ্কার করে ধীরে ধীরে জনবসতি গড়ে ওঠে। প্রধাণত মেদিনীপুর জেলার কিছু মানুষ এখানে এসে বসবাস আরম্ভ করে। ক্রমশ গড়ে ওঠে নানা গ্রাম। সেজন্য শ্যামপুরের অনেক গ্রাম-নামের সঙ্গে মেদিনীপুরের অনেক গ্রাম-নামের মিল পাওয়া যায়। এই অঞ্চলটি একসময় নদীগর্ভে ছিল বলেই সাম্প্রতিক অতীতে পুকুর, কুয়ো ইত্যাদি খনন করতে গিয়ে কোথাও নৌকোর মাস্তুল কোথাও নৌকোর খোল ইত্যাদি পাওয়া গেছে। আনুমানিক ১০০ বছর আগে পুরুলপাড়া গ্রামের সমরেশ প্রমাণিকের পূর্বপুরুষ কৃষ্ণপদ প্রামানিকের পুকুর খুঁড়তে খুঁড়তে একটি নৌকার খোল ও মানুষের হাড় পাওয়া গিয়েছিল।
প্রায় দুশো বছরেরও কিছু আগে বর্ধমান থেকে আগত কৃষ্ণপদ মিত্রের পূর্বপুরুষ কুঁড়েরাম বোস স্থানীয় জঙ্গল থেকে একটি শিলা উদ্ধার করে বারাহি চন্ডী নামে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। এই চন্ডীমন্দিরের ২-৩ বছর পরে এখানকার শিব মন্দিরটি স্থাপিত হয়। পরে কুঁড়েরাম অষ্টধাতুর একটি রাধারমণ জিউ-এর মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করেন। আনুমানিক ৮০-৯০ বছর আগে প্রফুল্ল সামন্তের পিতামহ স্থানীয় একটি পুকুর থেকে একটি শিলা উদ্ধার করেন যা শীতলা দেবী রূপে বর্তমানে পূজিত হচ্ছে। তবে শীতলা মন্দিরে শীতলা দেবী ছাড়াও পঞ্চানন্দ, গঙ্গা, মনসা, ষষ্ঠী ও জ্বরাসুরের বর্ণময় সবাহন দারুবিগ্রহ রয়েছে যাদের নির্মাণশৈলী অনবদ্য।





***********
তথ্য সূত্রঃ-
১. হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৭৬
২. পশ্চিমবাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য মন্দির মসজিদ - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৯৮
৩. হাওড়া জেলার ইতিহাস -২য় খন্ড - অচল ভট্টাচার্য, ১৯৮২
৪. বাংলার মন্দির :স্থাপত্য ও ভাস্কর্য- প্রণব রায়, ১৯৯১
৫. হাওড়া জেলার ইতিহাস -হেমেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,১৯৯৯
@অনুসন্ধানে - আশিস চক্রবর্তীঅমলেন্দু বেরা
# প্রকাশিত - 'প্রতিদিনের গেরো ' পাক্ষিক পত্রিকা ( ১লা অক্টোবর, ২০০৭)

Tuesday, December 8, 2020

পঞ্চম পর্ব-- নুনেবাড় (Nunebarh)

হাওড়া জেলার দক্ষিণে শ্যামপুর থানার অন্তর্গত নুনেবাড় গ্রামের (২২.২৮°উ, ৮৭.৯৮°পূ) নামকরণ সম্পর্কে প্রামাণ্য কোনো নথি পাওয়া যায় না। তবে যে জনশ্রুতিটি রয়েছে তা হল 'বাড়' শব্দের অর্থ ধার বা তীরভূমি। অঞ্চলটি রূপনারায়ণের নোনাজল বিধৌত; সেকারণেই গ্রামের নাম নুনেবাড়।

৬৮৯ টি পরিবার নিয়ে গঠিত এই গ্রামের সত্তাধিকারী ছিলেন বর্তমান হাওড়া-হুগলী সীমানায় অবস্থিত ঝিকিরা-প্রতাপপুরের রায় বংশের পত্তনিদাররা। ললিতমোহন রায়, কিশোরীমোহন রায় প্রমুখ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। পূর্বে এই গ্রামের শিবমন্দিরের দক্ষিণে রায়েদের কাছারি বাড়ি ছিল।
গ্রামের পূর্ব দিক দিয়ে প্রবাহিত নুনেবাড়- কোটরা নামে পরিচিত খালটি কমলপুর হাটের উত্তর দিক দিয়ে গিয়ে কোটরার জয়চন্ডী পাড়ার কামিনীঘাটায় শেষ হয়েছে। এই খালপথটি পূর্বে এত চওড়া ছিল যে ৪০০- ৫০০ মণের বোট অনায়াসে যাতায়াত করতে পারতো। এক সময় এই খালের জলবন্টন নিয়ে কমলপুরের ঘোষ এবং এখানকার রায় পত্তনিদারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাঁধে। শেষ পর্যন্ত নুনেবাড় থেকে কিছু জমি কমলপুরের ঘোষদের দেওয়ার বিনিময়ে মীমাংসা হয় ও খালে জল ফেলার ছাড়পত্র মেলে।

গ্রামের অন্যতম পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনটি হল পঞ্চানন্দ মন্দিরের বিগ্রহ যা আসলে কষ্টিপাথরের ভগ্ন বিষ্ণুমূর্তির ওপরের অংশ।উচ্চতা প্রায় আড়াই ফুট। আনুমানিক ১৩০০ বঙ্গাব্দে নুনেবাড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তর দিকে বিবেকানন্দ সামন্তের পূর্বপুরুষ ভজহরি সামন্তের পুকুর খননের সময় এই বিগ্রহটি পাওয়া যায়। পরবর্তী কালে তাঁর স্ত্রী সুন্দরীবালা সামন্ত স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে সেটিকে পঞ্চানন্দ রূপে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। বিগ্রহটির সঙ্গে খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ -ত্রয়োদশ শতকের ভাস্কর্য শৈলীর মিল রয়েছে ।

১৯৭০- ১৯৭৫ সাল নাগাদ স্থানীয় গোপীবল্লভ সামন্তের পুকুর খনন কালে মাটির তলায় সারিবদ্ধ ভাবে ৩৮x২৫x৬ সে.মি. মাপের অনেক ইট পাওয়া গিয়েছিল। যেগুলির একদিকে একটি সরু কাঠের গুঁড়ি এবং তাকে আটকে রাখার জন্য দু'পাশে দুটি কাঠের গোঁজ মাটিতে পোঁতা অবস্থায় ছিল।
এখানকার প্রাচীন শিবমন্দিরটি রায় পত্তনিদারদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হলেও শিবের দেবত্র সম্পত্তি বর্ধমান রাজার দান।সমগ্র হাওড়া জেলার নানা গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য শিবমন্দিরের উৎপত্তির ইতিহাসের কোনো প্রামাণ্য নথি আজ আর পাওয়া সম্ভব নয়। তবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই সাধারণ যে জনশ্রুতিটি রয়েছে তা হল, সেগুলি বর্ধমান রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছে। এর কারণ, ১৭২২ খ্রীষ্টাব্দে মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে এবং ১৭২৪ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর জামাতা সুজাউদ্দিনের আমলে ভূমিরাজস্ব বিধি সংশোধনের জন্য হাওড়া সদর মহকুমার বিরাট অংশ ও সমগ্র উলুবেড়িয়া মহকুমা বর্ধমান জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয়। এই জমিদাররা ধর্মপ্রাণ ছিলেন। শিবমন্দিরের সম্বৎসর পূজা অর্চনার জন্য অনেক জমি তাঁরা দেবত্র সম্পত্তি হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। গ্রামের মানুষদের মুখে এখনো শোনা যায় 'শিবের পুকুর', 'শিবের জমি' ইত্যাদি। যদিও পরবর্তী কালে সেই সব জমি জায়গা দখলদারির কারণে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
বর্ধমান জমিদারির এই অঞ্চলটি অতীতে মন্ডলঘাট পরগনার মধ্যেই ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৫৮২ খ্রীষ্টাব্দে টোডরমলের রাজস্ব এলাকা বিভাগের সময় বর্তমান হাওড়া জেলার সমগ্র অংশ সুবা বাংলার যে তিনটি 'সরকার'-এ (সাতগাঁ, সুলিয়ামানাবাদ এবং মান্দারন) বিভক্ত করা হয় তার মধ্যে মান্দারন সরকারের অন্তর্গত ছিল মন্ডলঘাট পরগনা। অবশ্য আইন- ই- আকবরীতে বলা হয়েছে, প্রথমদিকে মন্ডলঘাট ছিল সরকার মান্দারনের একটি 'মহল' মাত্র, পরে পরগণায় রূপান্তরিত হয়। মুর্শিদকুলি খাঁর শাসনতান্রিক সংস্কারে ১০০ গ্রামে ১টি পরগণা হত। পরগণাগুলির মধ্যে মন্ডলঘাট ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ১৭০৩ সালের একটি পাইলট চার্টে দামোদর নদকে 'মন্ডলঘাট নদ' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।তার কারণ হয়তো মন্ডলঘাট পরগণার মধ্যে দিয়ে এই নদের নিম্নগতি প্রবাহ। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাম্রলিপ্ত বন্দরের সঙ্গে এই মন্ডলঘাট পরগনার আদান- প্রদান চলত। আইন-ই- আকবরী অনুসারে মন্ডলঘাট পরগনার রাজস্ব ছিল ৯,০৬,৭৭৫ দাম।

কোনো নির্দিষ্ট মন্দির না থাকলেও নুনেবাড় গ্রামে প্রায় ১৫০ বছর ধরে মহাকালীর পূজা হয়ে আসছে।পূর্বে ১২ বছর অন্তর এই পূজা উপলক্ষে মোষ বলির প্রথা প্রচলিত ছিল কিন্তু পরবর্তী কালে আর্থিক কারণে এবং বলিকে কেন্দ্র করে গ্রামের মানুষের মতভেদের জন্য তা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে মোষের পরিবর্তে মেষ বলির প্রথা রয়েছে। পূর্বে মহাকালীর নামে ৩০ বিঘা জমি দেবত্র সম্পত্তি ছিল, এখন তা আনুমানিক দেড় বিঘা। গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তের শীতলা মন্দিরটিও প্রায় সমসাময়িক।
*********
তথ্য সূত্রঃ-
১. হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৭৬
২. পশ্চিমবাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য মন্দির মসজিদ - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৯৮
৩. হাওড়া জেলার ইতিহাস -২য় খন্ড - অচল ভট্টাচার্য, ১৯৮২
৪. Bengal District Gazetteer Howrah -L.S.S.Omalley,1909
৫. বাংলার মন্দির :স্থাপত্য ও ভাস্কর্য- প্রণব রায়, ১৯৯১
৬. হাওড়া জেলার ইতিহাস -হেমেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৯৯
৭. মানচিত্র সৌজন্যঃ গঙ্গা পথের ইতিকথা - অশোককুমার বসু
@অনুসন্ধানে - আশিস চক্রবর্তীঅমলেন্দু বেরা
# প্রকাশিত - 'প্রতিদিনের গেরো' পাক্ষিক পত্রিকা ( ১লা নভেম্বর, ২০০৭)

Friday, November 13, 2020

চতুর্থ পর্বঃ লোকশিল্পের আঙিনা - দেওয়ালি পুতুল (Diwali Doll)

'পুতুল ' শব্দটি সংস্কৃত ' পুত্তলিকা ' থেকে এসেছে যার অর্থ মৃত্তিকাদি নির্মিত প্রতিমূর্তি। "পুতুল কল্পনায় মানবমনের অপরূপ ভাবনার চিহ্ন আছে। প্রকৃতপক্ষে এটি মানুষের সংস্কৃতিগত বিবর্তনের এবং মানুষের মনন- কল্পনার ভাবসমৃদ্ধ অনন্য মূর্তি।" মনে করা হয়, মানুষের অনুকরণস্পৃহা, সংকেতপ্রবণতা, অনিষ্টকারী শক্তিকে বশে আনার ভাবনা ও অলৌকিকত্বে বিশ্বাস থেকেই পুতুলের জন্ম। যে মাধ্যমে গড়া হোক না কেন, এর মধ্যে কল্পনার যে অবাধ বৈচিত্র্য, শৈলীর যে নানাবিধ অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় তা দেশ, কাল, সম্প্রদায়ের গন্ডী অতিক্রম করে সহজ সৌন্দর্যকেই দ্যোতিত করে।

দীপলক্ষ্মী বা দেওয়ালি পুতুল দীপাবলি উৎসবের সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে যুক্ত। তবে এর প্রথম প্রচলন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের মতে, "৫২৭ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে কার্তিক মাসে স্বাতিনক্ষত্রে অমাবস্যার রাত্রি শেষে জৈনগুরু মহাবীরের নির্বাণপ্রাপ্তি হলে তাঁর নির্বাণস্থান পাবা নগরীতে দীপদানোৎসব হইয়াছিল।(হরিবংশ) ইহাই দীপাবলীর মূল বলিয়া উক্ত।" আবার অনেকে মনে করেন, রামচন্দ্র রাবনবধ করে সীতাকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরলে তাঁদের আগমন হেতু আলোর উৎসবের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানই দীপাবলি।



দেওয়ালি পুতুল পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর এবং হাওড়া জেলার কিছু জায়গায়; এছাড়া ঝাড়খন্ড, ওড়িষা ও পূর্ববঙ্গের মৈমনসিংহ অঞ্চলের কুম্ভকার শিল্পীরা মাটি দিয়ে নির্মাণ করেন যদিও স্থানভেদে এদের আঙ্গিক ও চিত্রণে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়।



অনেক গবেষক মনে করেন, দেওয়ালি পুতুল শিল্পীদের আদি বাসভূমি বিহার, রাণীগঞ্জ, ছোটোনাগপুর মালভূমি অঞ্চল। জীবন- জীবিকার টানে তাঁরা সেখান থেকে পুরুলিয়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। তারপর ক্রমশ মেদিনীপুর, বাঁকুড়া প্রভৃতি এলাকায় লোকশিল্পের এই ধারা ছড়িয়ে পড়ে। তাই ঘাগরা কাঁচুলি পরিহিতা পুতুলের আদলে অবাঙালি ছাপ লক্ষ্য করা যায়। আবার অনেকে মনে করেন, এই গড়ন কুমোরপাড়ার নিজস্ব শৈলী।


এগুলি পোড়ামাটির পুতুল। পোয়ানে পোড়ানোর পর কোনো কোনো অঞ্চলে রঙ করা হয়, কোথাও আবার ওই অবস্থাতেই রেখে দেওয়া হয়।এগুলির দৈর্ঘ্য ৩০ সেমি. থেকে ২ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। পুতুলের নিচের অংশটি সাধারণত গোলাকার লম্বা চাকে তৈরি ওল্টানো গ্লাসের মতো বা দীপদানের মতো যাকে রাঢ় অঞ্চলে 'দেরকো' বলা হয়। ওপরের অংশে একটি নারী মূর্তি দুই বা চার বা দশ হাতে এক বা একাধিক প্রদীপ ধরে থাকে। প্রদীপসজ্জা নানা ধরণের। কখনো দেখা যায়, নারীমূর্তিটি প্রসারিত দুই হাতে মাথার উপর দিয়ে বিস্তৃত একটি অর্ধবৃত্তাকার বেষ্টনী ধরে আছে এবং সেই বেষ্টনীর গায়ে তিন/ চার/ পাঁচ/ সাত/ দশ/তেরো/ ষোলোটি প্রদীপ বসানো রয়েছে। সাত প্রদীপযুক্ত দেওয়ালি পুতুলকে পুরুলিয়ায় 'সাতবহানিয়া' বলা হয়ে থাকে। পুরুলিয়া জেলার পুরুলিয়া শহর ছাড়াও বলরামপুর , ঝালদা, আদ্রা, ছাতাটাঁড় প্রভৃতি এলাকায় এই পুতুল পাওয়া যায়। কখনো আবার নারীমূর্তিটিকে বাঘ বা ঘোড়ার পিঠে প্রদীপ হাতে বসে থাকতে দেখা যায়।


পুরুলিয়া, ঝাড়খন্ড, মেদিনীপুরের পুতুলে নারীমূর্তির মুখ ছাঁচে তৈরি এবং তাদের মাথায় সুসজ্জিত মুকুট থাকে। অন্যত্র মুখ হাতে গড়া এবং তাতে আদিমতার ছাপ স্পষ্ট। বীরভূমের বোলপুর এলাকার পুতুল মেটে লাল এবং কালো উভয় রঙের হয়ে থাকে।

মেদিনীপুরের মানিকপুর ও মির্জাবাজার এলাকার দেওয়ালি পুতুলে বিশেষত্ব রয়েছে। প্রথাগত প্রদীপ সজ্জার পাশাপাশি এখানে নারীমূর্তির দুই হাতে সলতে লাগানোর ব্যবস্থা সমেত কেরোসিনের কুপি লক্ষ্য করা যায়। স্থানীয়ভাবে এগুলিকে 'পরীপুতুল' বলা হয়। লোকসংস্কৃতি গবেষক তারাপদ সাঁতরা মনে করেন, এই ধরণের প্রদীপ নির্মাণের ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের মৃৎশিল্পীরা উদ্ভাবনী বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। প্রদীপ দ্রুত নিভে যাওয়ার সম্ভাবনায় তাঁরা কেরোসিন কুপি যুক্ত করে পুতুলগুলিকে বেশ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে তুলেছেন।

পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর, ঝাড়খন্ড এলাকার পুতুলে লাল, নীল, কালো, হলদে, ও সাদা রঙের নানাবিধ অলংকরণ লক্ষ্য করা হয়। কোথাও কোথাও আকর্ষনীয় করে তোলার জন্য অভ্রগুঁড়ো মেশানো রুপোলি রঙের ব্যবহার দেখা যায় ।


**********
তথ্যসূত্রঃ-
১. পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পীসমাজ- তারাপদ সাঁতরা, ২০০০।
২. বাংলার লোকশিল্প - কল্যানকুৃমার গঙ্গোপাধ্যায়, ১৩৬৮।
৩. পশ্চিমবঙ্গের মৃৎশিল্প- দীপঙ্কর ঘোষ, ২০০২।
৪. জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস-বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, ১৯৯৪।
ক্ষেত্রসমীক্ষা ও লোকশিল্প সংরক্ষণে - আশিস চক্রবর্তীঅমলেন্দু বেরা

Sunday, November 8, 2020

তৃতীয় পর্ব-- গণেশপুর (Ganeshpur)

 হাওড়া জেলার দক্ষিণে শ্যামপুর থানার অন্তর্গত গণেশপুর গ্রামের (২২.৩৫°উ, ৮৮.০৪°পূ) নামকরণ সম্পর্কে জনশ্রুতি হল, এই গ্রাম যাঁরা পত্তন করেন তাঁরা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁকটিয়া থেকে এসেছিলেন। তাঁদের পদবি ছিল ঘোড়া। এঁদেরই প্রভাবশালী এক পুরুষের নাম ছিল গণেশ। তাঁরই নামানুসারে গ্রামের নাম হয় গণেশপুর।

গ্রামের অন্যতম পুরাকীর্তি হল লক্ষ্মী- জনার্দনের ( শালগ্রাম) পূর্বমুখী নবরত্ন মন্দিরটি। এই মন্দিরের ত্রিখিলান অলিন্দের ছাদ অর্ধবৃত্তাকার খিলানের দ্বারা এবং গর্ভগৃহের ছাদ চার দেওয়ালের কোনে উদ্গত লহরার উপর রক্ষিত নয়টি গম্বুজের দ্বারা নির্মিত। ভিতরের বারান্দায় বাম দিক দিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি পথে ত্রিতল এই মন্দিরের ছাদে ওঠা যায়। মন্দিরটি দৈর্ঘ্য প্রস্থে ২১'(৬.৪ মি.) এবং উচ্চতায় আনুমানিক ৪০'(১২.২মি.)।


কথিত আছে, বর্ধমান রাজার অধীনে চৈতন্যচরণ রায়ের কোনো এক পূর্বপুরুষ এ অঞ্চলে জমিদারি কিনে ' ভূস্বামী' হন এবং পূর্বের 'ঘোড়া' পদবি পরিবর্তন করে 'রায়' পদবি গ্রহণ করেন। কিন্তু গ্রামের লোকেরা আড়ালে ছড়া কেটে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েনি -
" ঘোড়া থেকে রায় হল
চাবুক খেয়ে প্রাণ গেল। "
তবে জমিদার চৈতন্যচরণ ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ । তিনি মা মেলাইচন্ডীর স্বপ্নাদেশে দামোদর নদীর তীরে বর্তমান জোয়ারকোল গ্রামের উত্তর- পূর্ব কোণে চাঁপাইখালি নামক স্থান থেকে মেলাইচন্ডী দেবীকে শিলামূর্তি অবস্থায় তুলে এনে গণেশপুরে মেলাই চণ্ডীর মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। তারই কিছুদিন পরে বহু অর্থ ব্যয়ে পাশে লক্ষ্মী- জনার্দন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।
মন্দিরের সামনের বাঁকানো কার্নিশের নিচে পোড়ামাটির ফলকে দু'পঙক্তির নিম্নলিখিত প্রতিষ্ঠা লিপিটি উৎকীর্ণ আছে : "শ্রী শ্রী রামচন্দ্র। সুভমস্তু সকাবদ্দা ১৭৪২ সক।সন ১২২৭ সাল। তাং ৯ই বৈশাখ পুস্যা নক্ষত্র। /বৃহস্পতিবার আরম্ভ কিত্তি শ্রী চৈতন্যচরণ রায়।গঠনাথ শ্রী রামপ্রসাদ চন্দ্র মিস্ত্রিরী সাং রাঔতাড়া।" অর্থাৎ ১৭৪২ শকাব্দ বা ১২২৭ বঙ্গাব্দ বা ১৮২০ খ্রীঃ চৈতন্যচরণ রায়ের নির্দেশে রাওতাড়া নিবাসী স্থপতি রামপ্রসাদ চন্দ্র মন্দিরটি নির্মাণ করেন। হাওড়া জেলার সেকালের যশস্বী মন্দির স্থপতি ছিলেন রামপ্রসাদ চন্দ্র। তিনি মোট তিনটি মন্দির নির্মাণ করেন;ঝিকিরায়,গনেশপুরে ও কল্যানপুরে। ফলে মন্দিরগুলির ভাস্কর্যশৈলীর মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান। জেলার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য মন্দির-স্থপতিরা হলেন অভয়চরণ মিস্ত্রি, রামমোহন মিস্ত্রি, রাজনারায়ণ মিস্ত্রি, সুকদেব মিস্ত্রি, হৃষীকেশ মিস্ত্রি, গোপাল কর্মী, গুইরাম সূত্রধর,মহেশচন্দ্র সেন প্রমুখ।

পঙ্খসজ্জা (Stucco) সেকালের মন্দির- স্থাপত্যে একটি অন্যতম শিল্পশৈলী হিসেবে বিবেচিত হত। পোড়ামাটির ভাস্কর্য (টেরাকোটা) সৃষ্টি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে মূলত উনিশ শতক থেকে পঙ্খসজ্জা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পঙ্খের অলংকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়, জোংড়া বা বাখারি চুনকে (শামুক -ঝিনুক পুড়িয়ে প্রস্তুত চুন) কয়েকদিন ভিজিয়ে রাখর পর সেটিকে জল থেকে তুলে একটা পরিস্কার কাপড়ে বেঁধে জল ঝরে যাওয়া পর্যন্ত ছাই বা বালির গাদায় রেখে দেওয়া হয়।তারপর ঐ চুনের সঙ্গে পরিমাণমতো গুড় ও অন্যান্য দ্রব্য মিশিয়ে প্রস্তুত পলেস্তারাটি নির্দিষ্ট জায়গায় লেপে দেওয়া হয়। এরপর 'সুর্মা' বা নরুনের মতো ছোটো সরু লম্বা বাটালি দিয়ে খোদাই করে ইচ্ছে মতো নকশা তৈরি করা হয়।

লক্ষ্মী- জনার্দন মন্দিরের ভিতরের দেওয়ালে ওপরের দিকে কিছু পঙ্খের অলংকরণ এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। কয়েক বছর পরে হয়তো তার আর কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। অলংকরণগুলির একটিতে রয়েছে প্রস্ফুটিত ফুলের বৃন্তের দুধারে দুটি পাখি পরস্পর বিপরীতমুখী এবং ঠিক ওপরের ফুলের পাপড়ির মধ্যে ঠোঁট ডুবিয়ে বসে থাকা অন্য দুই পাখি পরস্পর মুখোমুখি। এই চিত্রটি একটি বৃত্তের মধ্যে অলঙ্কৃত। এছাড়া ফুল লতাপাতার নকশা বিদ্যমান। তবে মন্দিরের সামনের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে টেরাকোটার কাজ। পঙ্খসজ্জা ও টেরাকোটার যুগপৎ অবস্থান দেখে অনুমান করা যায় যে টেরাকোটার ক্রমঅবলুপ্তির যুগে পঙ্খের অলংকরণ প্রসার লাভ করেছিল। এই মন্দিরটি সেই সন্ধিলগ্নের শিল্পসুষমাকে ধারণ করে আছে।


মন্দিরের সামনের প্রবেশপথের ওপরের অংশে নিবদ্ধ পোড়ামাটির ফলকগুলি কোথাও ওপর থেকে নিচে আবার কোথাও ভূমির সমান্তরালে বাম দিক থেকে ডান দিকে সার দিয়ে সাজানো । তবে অনেকগুলি ফলক বর্তমানে লুপ্ত।
কার্নিশের নিচে ওপরের সারিতে বাম দিক থেকে ডান দিকে --->১) মৎস্য অবতার, ২) কূর্ম অবতার, ৩) কল্কি অবতার, ৪) জগন্নাথ - বলরাম- সুভদ্রা, ৫) হংসবাহনে উপবিষ্ট চতুর্মুখ ব্রহ্মা, ৬) হস্তিপৃষ্ঠে উপবিষ্ট ইন্দ্র, ৭) মহিষাসুরমর্দিনী, ৮).................., ৯) ব্রহ্মা, ১০) গৌর-নিতাই, ১১) রাধাকৃষ্ণ, ১২) জগাই - মাধাই, ১৩) কালী, ১৪) রাবন।



নিচের সারিতে বাম দিক থেকে ডান দিকে ---> ১) নৃসিংহ অবতার, ২) বামন অবতার, ৩) রাম- বলরাম, ৪) নৃত্যরত বালক- বালিকা, ৫) পুরুষ ও মহিলার কাঁখে একটি করে শিশু, ৬) ভগীরথের গঙ্গা আনয়ণ, ৭)..........., ৮)..........., ৯) নারীমুখ, ১০) ঢেঁকিপেতে বসে আছে পুরুষ ও নারী, ১১) বীণা হাতে নারদ, ১২) বিশ্বামিত্র - রাম- লক্ষ্মণ, ১৩) যুদ্ধরত রাম- লক্ষ্মণ, ১৪) তলোয়ার হাতে রাক্ষসদ্বয়।
উপরোক্ত সমান্তরাল সারি দুটির মাঝে মাঝে একটি করে মোট ছয়টি মূর্তি রয়েছে। বাম দিক থেকে ডান দিকে ---> ১) সিঙ্গা হাতে দণ্ডায়মান পুরুষ, ২) মৃদঙ্গবাদনরত দণ্ডায়মান পুরুষ, ৩) বাহুতুলে নৃত্যরত পুরুষ, ৪) অনুরূপ, ৫) ২-এর অনুরূপ, ৬) ১- এর অনুরূপ।
মন্দিরের সামনের দেওয়ালের একদম বামদিকে প্রান্তে উপর থেকে নিচে ---> ১) কৃষ্ণ - সুদামা, ২) কংস বধ, ৩) উন্মত্ত হস্তি ও কৃষ্ণ, ৪) কালীয়দমন, ৫) পার্থসারথি, ৭)..........., ৮)........., ৯).............১০)............, ১১)........্‌ ১২).............।


ডানদিকের প্রান্তে ওপর থেকে নিচে ---> ১) গাছ থেকে কৃষ্ণ ফল পাড়ছে,নিচে পাহারাদার, ২) অনুরূপ, ৩) বসুদেব কৃষ্ণকে কোলে নিয়ে যাচ্ছে, ৪) রাধাকৃষ্ণ, ৫) গোদোহন, ৬) ঢেঁকিবাহনে নারদের সামনে কৃষ্ণ, ৭) যশোদা- নন্দের মাঝে কৃষ্ণ, ৮)........, ৯).........., ১০).........., ১১)........।



মন্দিরের তিনটি প্রবেশপথের চারটি স্তম্ভের উপরে একটি করে মোট চারটি টেরাকোটার সজ্জা লক্ষ্য করা যায়,যা ওপর থেকে নিচের দিকে লম্বমান। একেবারে বামে ---> ১)দুটি বাঘের উপর তরবারি হাতে উদ্যত দু'জন সৈনিক, ২) দুটি বাঘের উপর দুটি হাতি,তার উপর দু'জন সৈনিক, ৩) দুটি সিংহের উপর দুটি হাতি, তার উপর দু'জন সৈনিক। এরপরের সজ্জায়----> ১) দুটি সিংহের উপর দুজন সৈনিক, ২) দুটি সিংহের উপর দুটি হাতি, তার উপর দুজন সৈনিক, ৩) দুটি ঘোড়ার উপর দুটি হাতি, তার উপর সৈনিক, ৪) দুটি সিংহের উপর দুটি ঘোড়া, তার উপর দু'জন সৈনিক। পরের সারিতে---> ১) দুটি বাঘের উপর দু' জন সৈনিক, ২) দুটি বাঘের উপর দুটি হাতি, তার উপর দুজন সৈনিক, ৩) দুটি ঘোড়ার উপর দুটি হাতি, তার উপর দুজন সৈনিক, ৪) দুটি বাঘের উপর দুটি ঘোড়া, তার উপর দুজন সৈনিক। ডানদিকে ধারে---> ১) দুটি সিংহের উপর দুজন সৈনিক, ২) দুটি হাতির উপর দুজন সৈনিক, ৩).........।



মন্দিরের বাইরের তিনটি প্রবেশদ্বার পেরিয়ে আবার তিনটি প্রবেশদ্বার। মূল মন্দিরের বামে ও একেবারে ডানদিকে কানে মাকড়ি ও পায়ে মল পরিহিতা এবং হাতবায়া বাদনরতা চারফুট দীর্ঘ দুটি নারীমূর্তি রয়েছে। মাঝে দ্বারের দু'পাশে দুটি করে চারটি মূর্তি; দুটি দ্বাররক্ষক ও অপর দুটি বীণাবাদনরতা নারী। বলাবাহুল্য, টেরাকোটার মূর্তিগুলির মধ্যে পৌরানিক ও লৌকিক ধারার সমন্বয় ঘটেছে ।



লক্ষ্মী- জনার্দন মন্দিরের সামনে বাঁকানো কার্নিশ চারচাল যুক্ত গম্বুজাকৃতির প্রায় ১২ ফুট উচ্চতার চুনসুরকি গাঁথনির একটি তুলসীমঞ্চ আছে,যার গায়েও টেরাকোটার মূর্তি ও টালির কারুকাজ বিদ্যমান।


মন্দিরের বামপাশে দ্বিতল বিশিষ্ট ভগ্নপ্রায় জমিদার বাড়িটি ইতিহাসের ভারবাহী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে।



পড়ন্ত বিকেলের আলোর সঙ্গে তার নোনাধরা ইটের রঙের কোনো তফাৎ চোখে না পড়লেও চওড়া দেওয়াল মজবুত কড়িকাঠ ও ঘোরানো সিঁড়ি পেরিয়ে খোলা ছাদে দাঁড়ালে অনুভব করা যায় একসময়ের জাঁকজমকপূর্ণ বনেদিয়ানা।


লক্ষ্মী- জনার্দন মন্দিরের ৩০ মিটার দূরে উত্তর - পূর্ব কোণে চার চালবিশিষ্ট চন্ডী মন্দিরে দেবী মেলাইচন্ডী (শিলা) শীতলা, দক্ষিণরায়, মনসাদেবীর সঙ্গে পাথরের বেদীর উপর অবস্থান করতেন। প্রতিটি দেবদেবীর মঙ্গলঘটের সামনে নিজ নিজ বাহনের নিমকাঠের মূর্তি একসময় পুজিত হত কিন্ত বর্তমানে মন্দিরটি ভগ্নপ্রায় ও লতাগুল্ম আচ্ছাদিত হওয়ায় দেবদেবীদেরকে পাশের শিবমন্দিরে স্থানান্তরিত করা হলেও শিল্প সুষমামন্ডিত বাংলার দারু ভাস্কর্যের অপূর্ব নিদর্শন বাহনমূর্তিগুলি অবহেলায় পাশের ঝোপঝাড়ের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে প্রায় নষ্ট হতে বসেছে।



১৯৮০ সালের ৭ জুন (১৩৮৩ বঙ্গাব্দ, ২৩ জৈষ্ঠ্য) মঙ্গলবার সত্যযুগ পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী চন্ডীমন্দিরের ভিতরের দেওয়ালেও টেরাকোটা ও পঙ্খের কারুকাজ ছিল।
পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন আইন ২০০১ এর ২ নং ধারা অনুসারে বর্তমানে দুটি মন্দিরকেই সংরক্ষিত ও ঐতিহ্যসম্পন্ন পুরাকীর্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
**********************
তথ্য সূত্রঃ-
১. হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৭৬
২. পশ্চিমবাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য মন্দির মসজিদ - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৯৮
৩. হাওড়া জেলার ইতিহাস -২য় খন্ড - অচল ভট্টাচার্য, ১৯৮২
৪. হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার - অমিয় কুমার ব্যানার্জী,১৯৭২
৫. বাংলার কাঠের কাজ- তারাপদ সাঁতরা, ২০০৩
৬. হাওড়া জেলা লোকউৎসব - তারাপদ সাঁতরা, ২০০৫
৭. বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ-দুলাল চৌধুরী, ২০০৪
৮. বাংলার মন্দির :স্থাপত্য ও ভাস্কর্য- প্রণব রায়, ১৯৯১
অনুসন্ধানে - আশিস চক্রবর্তীঅমলেন্দু বেরা
প্রকাশিত - 'প্রতিদিনের গেরো ' পাক্ষিক পত্রিকা ( ১লা জুলাই , ২০০৭)

দশম পর্বঃ জাল্লাবাজের কথা (Jallabaz-er katha)

✍️   আশিস চক্রবর্তী  ও  অমলেন্দু বেরা হাওড়া জেলার দক্ষিনে শ্যামপুর থেকে গাদিয়াড়া সড়কের মধ্যে অবস্থিত গুজারপুর বাসস্টপ থেকে আড়াই কি. মি. দূরে...