Friday, November 13, 2020

চতুর্থ পর্বঃ লোকশিল্পের আঙিনা - দেওয়ালি পুতুল (Diwali Doll)

'পুতুল ' শব্দটি সংস্কৃত ' পুত্তলিকা ' থেকে এসেছে যার অর্থ মৃত্তিকাদি নির্মিত প্রতিমূর্তি। "পুতুল কল্পনায় মানবমনের অপরূপ ভাবনার চিহ্ন আছে। প্রকৃতপক্ষে এটি মানুষের সংস্কৃতিগত বিবর্তনের এবং মানুষের মনন- কল্পনার ভাবসমৃদ্ধ অনন্য মূর্তি।" মনে করা হয়, মানুষের অনুকরণস্পৃহা, সংকেতপ্রবণতা, অনিষ্টকারী শক্তিকে বশে আনার ভাবনা ও অলৌকিকত্বে বিশ্বাস থেকেই পুতুলের জন্ম। যে মাধ্যমে গড়া হোক না কেন, এর মধ্যে কল্পনার যে অবাধ বৈচিত্র্য, শৈলীর যে নানাবিধ অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় তা দেশ, কাল, সম্প্রদায়ের গন্ডী অতিক্রম করে সহজ সৌন্দর্যকেই দ্যোতিত করে।

দীপলক্ষ্মী বা দেওয়ালি পুতুল দীপাবলি উৎসবের সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে যুক্ত। তবে এর প্রথম প্রচলন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের মতে, "৫২৭ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে কার্তিক মাসে স্বাতিনক্ষত্রে অমাবস্যার রাত্রি শেষে জৈনগুরু মহাবীরের নির্বাণপ্রাপ্তি হলে তাঁর নির্বাণস্থান পাবা নগরীতে দীপদানোৎসব হইয়াছিল।(হরিবংশ) ইহাই দীপাবলীর মূল বলিয়া উক্ত।" আবার অনেকে মনে করেন, রামচন্দ্র রাবনবধ করে সীতাকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরলে তাঁদের আগমন হেতু আলোর উৎসবের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানই দীপাবলি।



দেওয়ালি পুতুল পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর এবং হাওড়া জেলার কিছু জায়গায়; এছাড়া ঝাড়খন্ড, ওড়িষা ও পূর্ববঙ্গের মৈমনসিংহ অঞ্চলের কুম্ভকার শিল্পীরা মাটি দিয়ে নির্মাণ করেন যদিও স্থানভেদে এদের আঙ্গিক ও চিত্রণে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়।



অনেক গবেষক মনে করেন, দেওয়ালি পুতুল শিল্পীদের আদি বাসভূমি বিহার, রাণীগঞ্জ, ছোটোনাগপুর মালভূমি অঞ্চল। জীবন- জীবিকার টানে তাঁরা সেখান থেকে পুরুলিয়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। তারপর ক্রমশ মেদিনীপুর, বাঁকুড়া প্রভৃতি এলাকায় লোকশিল্পের এই ধারা ছড়িয়ে পড়ে। তাই ঘাগরা কাঁচুলি পরিহিতা পুতুলের আদলে অবাঙালি ছাপ লক্ষ্য করা যায়। আবার অনেকে মনে করেন, এই গড়ন কুমোরপাড়ার নিজস্ব শৈলী।


এগুলি পোড়ামাটির পুতুল। পোয়ানে পোড়ানোর পর কোনো কোনো অঞ্চলে রঙ করা হয়, কোথাও আবার ওই অবস্থাতেই রেখে দেওয়া হয়।এগুলির দৈর্ঘ্য ৩০ সেমি. থেকে ২ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। পুতুলের নিচের অংশটি সাধারণত গোলাকার লম্বা চাকে তৈরি ওল্টানো গ্লাসের মতো বা দীপদানের মতো যাকে রাঢ় অঞ্চলে 'দেরকো' বলা হয়। ওপরের অংশে একটি নারী মূর্তি দুই বা চার বা দশ হাতে এক বা একাধিক প্রদীপ ধরে থাকে। প্রদীপসজ্জা নানা ধরণের। কখনো দেখা যায়, নারীমূর্তিটি প্রসারিত দুই হাতে মাথার উপর দিয়ে বিস্তৃত একটি অর্ধবৃত্তাকার বেষ্টনী ধরে আছে এবং সেই বেষ্টনীর গায়ে তিন/ চার/ পাঁচ/ সাত/ দশ/তেরো/ ষোলোটি প্রদীপ বসানো রয়েছে। সাত প্রদীপযুক্ত দেওয়ালি পুতুলকে পুরুলিয়ায় 'সাতবহানিয়া' বলা হয়ে থাকে। পুরুলিয়া জেলার পুরুলিয়া শহর ছাড়াও বলরামপুর , ঝালদা, আদ্রা, ছাতাটাঁড় প্রভৃতি এলাকায় এই পুতুল পাওয়া যায়। কখনো আবার নারীমূর্তিটিকে বাঘ বা ঘোড়ার পিঠে প্রদীপ হাতে বসে থাকতে দেখা যায়।


পুরুলিয়া, ঝাড়খন্ড, মেদিনীপুরের পুতুলে নারীমূর্তির মুখ ছাঁচে তৈরি এবং তাদের মাথায় সুসজ্জিত মুকুট থাকে। অন্যত্র মুখ হাতে গড়া এবং তাতে আদিমতার ছাপ স্পষ্ট। বীরভূমের বোলপুর এলাকার পুতুল মেটে লাল এবং কালো উভয় রঙের হয়ে থাকে।

মেদিনীপুরের মানিকপুর ও মির্জাবাজার এলাকার দেওয়ালি পুতুলে বিশেষত্ব রয়েছে। প্রথাগত প্রদীপ সজ্জার পাশাপাশি এখানে নারীমূর্তির দুই হাতে সলতে লাগানোর ব্যবস্থা সমেত কেরোসিনের কুপি লক্ষ্য করা যায়। স্থানীয়ভাবে এগুলিকে 'পরীপুতুল' বলা হয়। লোকসংস্কৃতি গবেষক তারাপদ সাঁতরা মনে করেন, এই ধরণের প্রদীপ নির্মাণের ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের মৃৎশিল্পীরা উদ্ভাবনী বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। প্রদীপ দ্রুত নিভে যাওয়ার সম্ভাবনায় তাঁরা কেরোসিন কুপি যুক্ত করে পুতুলগুলিকে বেশ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে তুলেছেন।

পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর, ঝাড়খন্ড এলাকার পুতুলে লাল, নীল, কালো, হলদে, ও সাদা রঙের নানাবিধ অলংকরণ লক্ষ্য করা হয়। কোথাও কোথাও আকর্ষনীয় করে তোলার জন্য অভ্রগুঁড়ো মেশানো রুপোলি রঙের ব্যবহার দেখা যায় ।


**********
তথ্যসূত্রঃ-
১. পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পীসমাজ- তারাপদ সাঁতরা, ২০০০।
২. বাংলার লোকশিল্প - কল্যানকুৃমার গঙ্গোপাধ্যায়, ১৩৬৮।
৩. পশ্চিমবঙ্গের মৃৎশিল্প- দীপঙ্কর ঘোষ, ২০০২।
৪. জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস-বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, ১৯৯৪।
ক্ষেত্রসমীক্ষা ও লোকশিল্প সংরক্ষণে - আশিস চক্রবর্তীঅমলেন্দু বেরা

Sunday, November 8, 2020

তৃতীয় পর্ব-- গণেশপুর (Ganeshpur)

 হাওড়া জেলার দক্ষিণে শ্যামপুর থানার অন্তর্গত গণেশপুর গ্রামের (২২.৩৫°উ, ৮৮.০৪°পূ) নামকরণ সম্পর্কে জনশ্রুতি হল, এই গ্রাম যাঁরা পত্তন করেন তাঁরা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁকটিয়া থেকে এসেছিলেন। তাঁদের পদবি ছিল ঘোড়া। এঁদেরই প্রভাবশালী এক পুরুষের নাম ছিল গণেশ। তাঁরই নামানুসারে গ্রামের নাম হয় গণেশপুর।

গ্রামের অন্যতম পুরাকীর্তি হল লক্ষ্মী- জনার্দনের ( শালগ্রাম) পূর্বমুখী নবরত্ন মন্দিরটি। এই মন্দিরের ত্রিখিলান অলিন্দের ছাদ অর্ধবৃত্তাকার খিলানের দ্বারা এবং গর্ভগৃহের ছাদ চার দেওয়ালের কোনে উদ্গত লহরার উপর রক্ষিত নয়টি গম্বুজের দ্বারা নির্মিত। ভিতরের বারান্দায় বাম দিক দিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি পথে ত্রিতল এই মন্দিরের ছাদে ওঠা যায়। মন্দিরটি দৈর্ঘ্য প্রস্থে ২১'(৬.৪ মি.) এবং উচ্চতায় আনুমানিক ৪০'(১২.২মি.)।


কথিত আছে, বর্ধমান রাজার অধীনে চৈতন্যচরণ রায়ের কোনো এক পূর্বপুরুষ এ অঞ্চলে জমিদারি কিনে ' ভূস্বামী' হন এবং পূর্বের 'ঘোড়া' পদবি পরিবর্তন করে 'রায়' পদবি গ্রহণ করেন। কিন্তু গ্রামের লোকেরা আড়ালে ছড়া কেটে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েনি -
" ঘোড়া থেকে রায় হল
চাবুক খেয়ে প্রাণ গেল। "
তবে জমিদার চৈতন্যচরণ ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ । তিনি মা মেলাইচন্ডীর স্বপ্নাদেশে দামোদর নদীর তীরে বর্তমান জোয়ারকোল গ্রামের উত্তর- পূর্ব কোণে চাঁপাইখালি নামক স্থান থেকে মেলাইচন্ডী দেবীকে শিলামূর্তি অবস্থায় তুলে এনে গণেশপুরে মেলাই চণ্ডীর মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। তারই কিছুদিন পরে বহু অর্থ ব্যয়ে পাশে লক্ষ্মী- জনার্দন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।
মন্দিরের সামনের বাঁকানো কার্নিশের নিচে পোড়ামাটির ফলকে দু'পঙক্তির নিম্নলিখিত প্রতিষ্ঠা লিপিটি উৎকীর্ণ আছে : "শ্রী শ্রী রামচন্দ্র। সুভমস্তু সকাবদ্দা ১৭৪২ সক।সন ১২২৭ সাল। তাং ৯ই বৈশাখ পুস্যা নক্ষত্র। /বৃহস্পতিবার আরম্ভ কিত্তি শ্রী চৈতন্যচরণ রায়।গঠনাথ শ্রী রামপ্রসাদ চন্দ্র মিস্ত্রিরী সাং রাঔতাড়া।" অর্থাৎ ১৭৪২ শকাব্দ বা ১২২৭ বঙ্গাব্দ বা ১৮২০ খ্রীঃ চৈতন্যচরণ রায়ের নির্দেশে রাওতাড়া নিবাসী স্থপতি রামপ্রসাদ চন্দ্র মন্দিরটি নির্মাণ করেন। হাওড়া জেলার সেকালের যশস্বী মন্দির স্থপতি ছিলেন রামপ্রসাদ চন্দ্র। তিনি মোট তিনটি মন্দির নির্মাণ করেন;ঝিকিরায়,গনেশপুরে ও কল্যানপুরে। ফলে মন্দিরগুলির ভাস্কর্যশৈলীর মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান। জেলার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য মন্দির-স্থপতিরা হলেন অভয়চরণ মিস্ত্রি, রামমোহন মিস্ত্রি, রাজনারায়ণ মিস্ত্রি, সুকদেব মিস্ত্রি, হৃষীকেশ মিস্ত্রি, গোপাল কর্মী, গুইরাম সূত্রধর,মহেশচন্দ্র সেন প্রমুখ।

পঙ্খসজ্জা (Stucco) সেকালের মন্দির- স্থাপত্যে একটি অন্যতম শিল্পশৈলী হিসেবে বিবেচিত হত। পোড়ামাটির ভাস্কর্য (টেরাকোটা) সৃষ্টি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে মূলত উনিশ শতক থেকে পঙ্খসজ্জা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পঙ্খের অলংকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়, জোংড়া বা বাখারি চুনকে (শামুক -ঝিনুক পুড়িয়ে প্রস্তুত চুন) কয়েকদিন ভিজিয়ে রাখর পর সেটিকে জল থেকে তুলে একটা পরিস্কার কাপড়ে বেঁধে জল ঝরে যাওয়া পর্যন্ত ছাই বা বালির গাদায় রেখে দেওয়া হয়।তারপর ঐ চুনের সঙ্গে পরিমাণমতো গুড় ও অন্যান্য দ্রব্য মিশিয়ে প্রস্তুত পলেস্তারাটি নির্দিষ্ট জায়গায় লেপে দেওয়া হয়। এরপর 'সুর্মা' বা নরুনের মতো ছোটো সরু লম্বা বাটালি দিয়ে খোদাই করে ইচ্ছে মতো নকশা তৈরি করা হয়।

লক্ষ্মী- জনার্দন মন্দিরের ভিতরের দেওয়ালে ওপরের দিকে কিছু পঙ্খের অলংকরণ এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। কয়েক বছর পরে হয়তো তার আর কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। অলংকরণগুলির একটিতে রয়েছে প্রস্ফুটিত ফুলের বৃন্তের দুধারে দুটি পাখি পরস্পর বিপরীতমুখী এবং ঠিক ওপরের ফুলের পাপড়ির মধ্যে ঠোঁট ডুবিয়ে বসে থাকা অন্য দুই পাখি পরস্পর মুখোমুখি। এই চিত্রটি একটি বৃত্তের মধ্যে অলঙ্কৃত। এছাড়া ফুল লতাপাতার নকশা বিদ্যমান। তবে মন্দিরের সামনের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে টেরাকোটার কাজ। পঙ্খসজ্জা ও টেরাকোটার যুগপৎ অবস্থান দেখে অনুমান করা যায় যে টেরাকোটার ক্রমঅবলুপ্তির যুগে পঙ্খের অলংকরণ প্রসার লাভ করেছিল। এই মন্দিরটি সেই সন্ধিলগ্নের শিল্পসুষমাকে ধারণ করে আছে।


মন্দিরের সামনের প্রবেশপথের ওপরের অংশে নিবদ্ধ পোড়ামাটির ফলকগুলি কোথাও ওপর থেকে নিচে আবার কোথাও ভূমির সমান্তরালে বাম দিক থেকে ডান দিকে সার দিয়ে সাজানো । তবে অনেকগুলি ফলক বর্তমানে লুপ্ত।
কার্নিশের নিচে ওপরের সারিতে বাম দিক থেকে ডান দিকে --->১) মৎস্য অবতার, ২) কূর্ম অবতার, ৩) কল্কি অবতার, ৪) জগন্নাথ - বলরাম- সুভদ্রা, ৫) হংসবাহনে উপবিষ্ট চতুর্মুখ ব্রহ্মা, ৬) হস্তিপৃষ্ঠে উপবিষ্ট ইন্দ্র, ৭) মহিষাসুরমর্দিনী, ৮).................., ৯) ব্রহ্মা, ১০) গৌর-নিতাই, ১১) রাধাকৃষ্ণ, ১২) জগাই - মাধাই, ১৩) কালী, ১৪) রাবন।



নিচের সারিতে বাম দিক থেকে ডান দিকে ---> ১) নৃসিংহ অবতার, ২) বামন অবতার, ৩) রাম- বলরাম, ৪) নৃত্যরত বালক- বালিকা, ৫) পুরুষ ও মহিলার কাঁখে একটি করে শিশু, ৬) ভগীরথের গঙ্গা আনয়ণ, ৭)..........., ৮)..........., ৯) নারীমুখ, ১০) ঢেঁকিপেতে বসে আছে পুরুষ ও নারী, ১১) বীণা হাতে নারদ, ১২) বিশ্বামিত্র - রাম- লক্ষ্মণ, ১৩) যুদ্ধরত রাম- লক্ষ্মণ, ১৪) তলোয়ার হাতে রাক্ষসদ্বয়।
উপরোক্ত সমান্তরাল সারি দুটির মাঝে মাঝে একটি করে মোট ছয়টি মূর্তি রয়েছে। বাম দিক থেকে ডান দিকে ---> ১) সিঙ্গা হাতে দণ্ডায়মান পুরুষ, ২) মৃদঙ্গবাদনরত দণ্ডায়মান পুরুষ, ৩) বাহুতুলে নৃত্যরত পুরুষ, ৪) অনুরূপ, ৫) ২-এর অনুরূপ, ৬) ১- এর অনুরূপ।
মন্দিরের সামনের দেওয়ালের একদম বামদিকে প্রান্তে উপর থেকে নিচে ---> ১) কৃষ্ণ - সুদামা, ২) কংস বধ, ৩) উন্মত্ত হস্তি ও কৃষ্ণ, ৪) কালীয়দমন, ৫) পার্থসারথি, ৭)..........., ৮)........., ৯).............১০)............, ১১)........্‌ ১২).............।


ডানদিকের প্রান্তে ওপর থেকে নিচে ---> ১) গাছ থেকে কৃষ্ণ ফল পাড়ছে,নিচে পাহারাদার, ২) অনুরূপ, ৩) বসুদেব কৃষ্ণকে কোলে নিয়ে যাচ্ছে, ৪) রাধাকৃষ্ণ, ৫) গোদোহন, ৬) ঢেঁকিবাহনে নারদের সামনে কৃষ্ণ, ৭) যশোদা- নন্দের মাঝে কৃষ্ণ, ৮)........, ৯).........., ১০).........., ১১)........।



মন্দিরের তিনটি প্রবেশপথের চারটি স্তম্ভের উপরে একটি করে মোট চারটি টেরাকোটার সজ্জা লক্ষ্য করা যায়,যা ওপর থেকে নিচের দিকে লম্বমান। একেবারে বামে ---> ১)দুটি বাঘের উপর তরবারি হাতে উদ্যত দু'জন সৈনিক, ২) দুটি বাঘের উপর দুটি হাতি,তার উপর দু'জন সৈনিক, ৩) দুটি সিংহের উপর দুটি হাতি, তার উপর দু'জন সৈনিক। এরপরের সজ্জায়----> ১) দুটি সিংহের উপর দুজন সৈনিক, ২) দুটি সিংহের উপর দুটি হাতি, তার উপর দুজন সৈনিক, ৩) দুটি ঘোড়ার উপর দুটি হাতি, তার উপর সৈনিক, ৪) দুটি সিংহের উপর দুটি ঘোড়া, তার উপর দু'জন সৈনিক। পরের সারিতে---> ১) দুটি বাঘের উপর দু' জন সৈনিক, ২) দুটি বাঘের উপর দুটি হাতি, তার উপর দুজন সৈনিক, ৩) দুটি ঘোড়ার উপর দুটি হাতি, তার উপর দুজন সৈনিক, ৪) দুটি বাঘের উপর দুটি ঘোড়া, তার উপর দুজন সৈনিক। ডানদিকে ধারে---> ১) দুটি সিংহের উপর দুজন সৈনিক, ২) দুটি হাতির উপর দুজন সৈনিক, ৩).........।



মন্দিরের বাইরের তিনটি প্রবেশদ্বার পেরিয়ে আবার তিনটি প্রবেশদ্বার। মূল মন্দিরের বামে ও একেবারে ডানদিকে কানে মাকড়ি ও পায়ে মল পরিহিতা এবং হাতবায়া বাদনরতা চারফুট দীর্ঘ দুটি নারীমূর্তি রয়েছে। মাঝে দ্বারের দু'পাশে দুটি করে চারটি মূর্তি; দুটি দ্বাররক্ষক ও অপর দুটি বীণাবাদনরতা নারী। বলাবাহুল্য, টেরাকোটার মূর্তিগুলির মধ্যে পৌরানিক ও লৌকিক ধারার সমন্বয় ঘটেছে ।



লক্ষ্মী- জনার্দন মন্দিরের সামনে বাঁকানো কার্নিশ চারচাল যুক্ত গম্বুজাকৃতির প্রায় ১২ ফুট উচ্চতার চুনসুরকি গাঁথনির একটি তুলসীমঞ্চ আছে,যার গায়েও টেরাকোটার মূর্তি ও টালির কারুকাজ বিদ্যমান।


মন্দিরের বামপাশে দ্বিতল বিশিষ্ট ভগ্নপ্রায় জমিদার বাড়িটি ইতিহাসের ভারবাহী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে।



পড়ন্ত বিকেলের আলোর সঙ্গে তার নোনাধরা ইটের রঙের কোনো তফাৎ চোখে না পড়লেও চওড়া দেওয়াল মজবুত কড়িকাঠ ও ঘোরানো সিঁড়ি পেরিয়ে খোলা ছাদে দাঁড়ালে অনুভব করা যায় একসময়ের জাঁকজমকপূর্ণ বনেদিয়ানা।


লক্ষ্মী- জনার্দন মন্দিরের ৩০ মিটার দূরে উত্তর - পূর্ব কোণে চার চালবিশিষ্ট চন্ডী মন্দিরে দেবী মেলাইচন্ডী (শিলা) শীতলা, দক্ষিণরায়, মনসাদেবীর সঙ্গে পাথরের বেদীর উপর অবস্থান করতেন। প্রতিটি দেবদেবীর মঙ্গলঘটের সামনে নিজ নিজ বাহনের নিমকাঠের মূর্তি একসময় পুজিত হত কিন্ত বর্তমানে মন্দিরটি ভগ্নপ্রায় ও লতাগুল্ম আচ্ছাদিত হওয়ায় দেবদেবীদেরকে পাশের শিবমন্দিরে স্থানান্তরিত করা হলেও শিল্প সুষমামন্ডিত বাংলার দারু ভাস্কর্যের অপূর্ব নিদর্শন বাহনমূর্তিগুলি অবহেলায় পাশের ঝোপঝাড়ের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে প্রায় নষ্ট হতে বসেছে।



১৯৮০ সালের ৭ জুন (১৩৮৩ বঙ্গাব্দ, ২৩ জৈষ্ঠ্য) মঙ্গলবার সত্যযুগ পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী চন্ডীমন্দিরের ভিতরের দেওয়ালেও টেরাকোটা ও পঙ্খের কারুকাজ ছিল।
পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন আইন ২০০১ এর ২ নং ধারা অনুসারে বর্তমানে দুটি মন্দিরকেই সংরক্ষিত ও ঐতিহ্যসম্পন্ন পুরাকীর্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
**********************
তথ্য সূত্রঃ-
১. হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৭৬
২. পশ্চিমবাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য মন্দির মসজিদ - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৯৮
৩. হাওড়া জেলার ইতিহাস -২য় খন্ড - অচল ভট্টাচার্য, ১৯৮২
৪. হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার - অমিয় কুমার ব্যানার্জী,১৯৭২
৫. বাংলার কাঠের কাজ- তারাপদ সাঁতরা, ২০০৩
৬. হাওড়া জেলা লোকউৎসব - তারাপদ সাঁতরা, ২০০৫
৭. বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ-দুলাল চৌধুরী, ২০০৪
৮. বাংলার মন্দির :স্থাপত্য ও ভাস্কর্য- প্রণব রায়, ১৯৯১
অনুসন্ধানে - আশিস চক্রবর্তীঅমলেন্দু বেরা
প্রকাশিত - 'প্রতিদিনের গেরো ' পাক্ষিক পত্রিকা ( ১লা জুলাই , ২০০৭)

Saturday, November 7, 2020

দ্বিতীয় পর্ব-- শিবগঞ্জ (Shibganj)

 হাওড়া জেলার দক্ষিণে শ্যামপুর থানার অন্তর্গত শিবগঞ্জের(২২.২৫°উ, ৮৮.০৭°পূ) পূর্ব নাম ছিল কাশেমনগর বা কাশিমনগর।ঔরঙ্গজেবের প্রশাসনিক দপ্তরের কাশেম খাঁ আনুমানিক সতেরো শতকে এখানে একটি মসজিদ (?) নির্মাণ করেছিলেন, যার দৈর্ঘ্য ৫৩ ফুট,প্রস্থ ২৩ ফুট ও উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট ছিল।মসজিদটির ছাদ চার দেওয়ালের কোনে উদ্গত লহরার উপর রক্ষিত তিনটি গম্বুজ দ্বারা নির্মিত ছিল। কাশেম খাঁ- এর নামানুসারেই এই গ্রামের নাম হয় কাশেমনগর। পুরানো দলিলপত্রে স্থানটিকে কাশিমনগর হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে।

অনেকে বলেন,কাশেম খাঁ নির্মিত স্থাপত্য মসজিদ নয় দরগা। কারণ কাশেম খাঁ নিজে পীরের উপাসক ছিলেন। মসজিদের পুকুরকে কেউ কেউ পীরের পুকুর ও বলে থাকে। সাধারণত কোনো মসজিদে মানত করার কোনো প্রথা নেই। কিন্তু এখানে যারা আসে তারা সবাই মানত করে এবং পূর্বে এখানে মানত করে মাটির ঘোড়া উৎসর্গ করার প্রথা ছিল। কাশেম খাঁ নির্মিত স্থাপত্যটি বর্তমানে লুপ্ত। সেখানে নতুন করে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। এটি তিন গম্বুজ মসজিদ।মসজিদের পাশের মাঠে একটি ভগ্নপ্রায় প্রাচীন দেওয়ালের অংশ দেখা যায়, যাকে অনেকে ঘোড়ার আস্তাবল বলে মনে করেন।ঘোড়া পীরের বাহন। মসজিদের পিছনের দেওয়ালে একটি ডিম্বাকার খাঁজ(cave) থাকে। মৌলবি সেখানে বসেন পূর্ব দিকে মুখ করে এবং উপাসকরা তাঁর দিকে মুখ করে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে মুখ করে প্রার্থনা করেন।এই মসজিদে তেমন কোনো খাঁজ নেই। এসব কারনে এটিকে অনেকে পীরের দরগা বলে মনে করেন। মসজিদটি চক্রবর্তী পরিবার অধ্যুষিত অঞ্চলে অবস্থিত। এ গ্রামে কোনো মুসলমান ধর্মাবলম্বী নেই। তাই পার্শ্ববর্তী কামদেবপুর ও তেঁতুলবেড়িয়া গ্রামের মুসলিমরাই এই মসজিদের দেখভাল করেন। সরকারি নথিতে এটিকে মসজিদ হিসাবেই চিহ্নিত করা হয়েছে।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে দুর্ভিক্ষ ও প্রবল বন্যায় স্থানীয় মুসলমান অধিবাসীরা অন্যত্র চলে গেলে গ্রামটি পরিত্যক্ত হয়। এরপর আনুমানিক ১৮৫০ সালে নারিট- গাজীপুরের জমিদার শিব রায় এই কাশেমনগরের খেয়াঘাটের কাছে একটি হাট বসান।ক্রমশ এলাকাটি গঞ্জ হয়ে ওঠে এবং তাঁর নামেই কাশেমনগরের নাম বদলে হয় শিবগঞ্জ। বর্তমান মোল্লাহাটে জমিদার শিব রায়ের একটি কাছারি বাড়ি ছিল।
লোকশ্রুতি অনুযায়ী,মসজিদের পুরানো ইটে একবার বাঘের পায়ের ছাপ পাওয়া গিয়েছিল। তবে বাঘের উপস্থিতির সত্যতা থাক বা না থাক এই অঞ্চলটি যে একসময় জঙ্গলাকীর্ণ ছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ গ্রামের উত্তর পাড়ায় বাঘ বাহনে আসীন বিশালাক্ষী দেবীর মন্দির আছে যা আনুমানিক ২০০ বছরের পুরানো। তবে মাটির তৈরি প্রাচীন মন্দিরটি সংস্কার করে ইটের করা হয়েছে। মন্দিরে বিশালাক্ষী ছাড়াও লক্ষ্মী, সরস্বতী, গনেশ,মনসা প্রভৃতি দেবদেবীও রয়েছেন। এই মন্দিরে পৌরহিত্য করেন হেমন্ত চক্রবর্তীর পূর্ব ও উত্তরসূরীরা।এছাড়াও সূর্য মন্ডলের বাড়ির পাশে রাঢ় বাংলার অরণ্যদেবতা দক্ষিণ রায় দীর্ঘকাল ধরে পূজিত হয়ে আসছেন।
কথিত আছে, মতিলাল চক্রবর্তীর জমিতে একবার এক ফকির এসে মাটির তিনটি ঢিপি তৈরি করেছিলেন। সেখানে সেই থেকে ওলাবিবির পূজা হয় প্রত্যেক মাঘী পূর্ণিমায় এবং সেই ঢিপি অস্থায়ী।
গ্রামের শীতলা মন্দিরটি শরৎ নন্দীর বাবা সদয় নন্দী নির্মাণ করেছিলেন। পৌরহিত্যের দায়িত্ব দিয়েছিলেন আশিস চক্রবর্তীর ঠাকুরদার জ্যাঠামশাই মতিলাল চক্রবর্তীর উপর। এটি শিব- শীতলা মন্দির।
গ্রামে স্বর্গীয় শরৎ নন্দীর নামে একটি সমাধি মন্দির ও বৃষকাষ্ঠ আছে। বৃষকাষ্ঠ হল হিন্দুদের শ্রাদ্ধে নিবেদিত প্রায় ৬-৭ ফুট দীর্ঘ ও ৫-৭ ইঞ্চি ঘনত্বের বেল বা নিম কাঠের তৈরি একটি নকশা - খোদাই স্তম্ভ। একে 'বৃষধ্বজ' বা 'বেরোষ' ও বলা হয়। 'শুদ্ধি তত্ত্ব' ও 'মৎসপুরাণে' এর উল্লেখ রয়েছে। চৌপল স্তম্ভটিকে কুঁদে একজন পুরুষ বা নারীর ( যার শ্রাদ্ধ হচ্ছে সেই অনুযায়ী) মূর্তিকে ভারবাহী করে ২- ৩ টি শিবলিঙ্গ শোভিত মন্দির খোদাই করা হত। তারপর নানাবিধ রঙের প্রয়োগ করে নিচের দিকের কিছুটা অংশ জলাশয়ের কাছে পুঁতে দেওয়া হত। বাংলার সূত্রধর সমাজের শিল্পীরাই এগুলি নির্মাণ করত যা বর্তমানে অবলুপ্ত। হাওড়া জেলার বিশিষ্ট বৃষকাষ্ঠ শিল্পী ছিলেন কৃষ্ণবাটি গ্রামের পরান দাস,গড়বালিয়ার কিশোরী দাস,বাগনানের যোগীন কুন্ডু ও কিশোরী সাঁই এবং শ্যামপুরের গণেশচন্দ্র মান্না।

তথ্য সূত্রঃ-
১. ৫০০ বছরের হাওড়া-হেমেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,১৯৯২
২. পশ্চিমবাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য মন্দির মসজিদ - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৯৮
৩. হাওড়া জেলার ইতিহাস -২য় খন্ড - অচল ভট্টাচার্য, ১৯৮২
৪. হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৭৬
৫. হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার - অমিয় কুমার ব্যানার্জী,১৯৭২
৬.বাংলার কাঠের কাজ- তারাপদ সাঁতরা, ২০০৩
৭.বাংলার লোকশিল্প -ড. প্রদ্যোত ঘোষ,২০০৪
অনুসন্ধানে - আশিস চক্রবর্তীঅমলেন্দু বেরা
প্রকাশিত - 'প্রতিদিনের গেরো ' পাক্ষিক পত্রিকা( ১লা মে, ২০০৭)

Friday, November 6, 2020

প্রথম পর্ব- গাদিয়াড়া (Gadiara)

হুগলি ও রূপনারায়ণ নদের সঙ্গমস্থলে হাওড়া জেলার দক্ষিণতম ভূখণ্ড হল 'গাদিয়াড়া ' ( উত্তর-২২°১৩' ও দক্ষিণ- ৮৮°০২') যার পূর্বে দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও দক্ষিণে পূর্ব মেদনীপুর অবস্থিত।এর নামকরণ সম্পর্কে স্থানীয় মানুষদের ধারণা, রূপনারায়ণের দক্ষিণ পাড়ের গেঁওখালি থেকে আড়া তৈরির জন্য গরাণ কাঠ একত্রিত করে ( স্থানীয় ভাষায় গাদাগাদি করে) বেঁধে এই অঞ্চলে আনা হত এবং এখান থেকে দক্ষিণ হাওড়ার বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি করা হত।তাই এই আড়ার গাদি বা স্তুপ থেকে নামকরণ 'গাদিয়াড়া' হয়েছে বলে মনে হয়।

পুরাতন দলিলপত্রে এবং ১৯০৯ সালে প্রকাশিত Howrah District Gazetteer-এ এই স্থানকে ' মাকড়া পাথর ' নামে উল্লেখ করা হয়েছে(মাকড়া শব্দের অর্থ হল ঝামা পাথর)। এখনো গাদিয়াড়া ফেরীঘাট থেকে ১০০ মিটার পূর্বে নদীর বাঁধের ধারে একটি বট গাছের নিচে কয়েকটি কালো রঙের শিলাকে মাকড়চন্ডী নামে পুজো করা হয়। আগে এর অবস্থান ছিল ২০০ ফুট দক্ষিণে।নদীর বিস্তৃতির জন্য এখন উত্তরে সরিয়ে আনা হয়েছে।

বিভিন্ন গবেষণায় এই স্থানটিকে ' James and Merry Sand' নামেও উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ ১৬৯৪ সালে সেপ্টেম্বর মাসে জেমস্ অ্যান্ড মেরী নামে একটি জাহাজ বালেশ্বর থেকে হুগলী নদীর মুখে ঢোকার সময় তাম্বোলী পয়েন্টের এক চড়ায় ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায়। Bengal letter to court, এর এক জায়গায় বলা হয়েছে - " Tamboli point is shown in the pilot chart 1703 at the present site of Fort Mornington Point. " ইংল্যান্ডের রাজা জেমস্ ও রানী মেরী অফ্ মডেনার নামে জাহাজটির নাম থাকায় চড়াটির এমন নাম হয়েছে বলে মনে করা হয়। অতীতে এর অবস্থান ছিল হুগলি নদীর প্রায় মাঝবরাবর।
বর্তমানে কেবল এর পূর্ব দিক দিয়ে স্রোত প্রবাহিত হলেও আগে এর পশ্চিম দিকেও প্রবল স্রোত ছিল।
অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পর্যবেক্ষণে জানিয়েছেন, রূপনারায়ণ ও দামোদরের খাত পরিবর্তিত হওয়াতেই এই চড়ার সৃষ্টি। দুদিক দিয়ে স্রোত থাকায় প্রচন্ড ঘূর্ণি ছিল যার প্রভাবে জাহাজ চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৬৭৬ সালে Streyn-shyam Master নামের এক ইংরেজ ক্যাপ্টেন তাঁর দিনলিপিতে সেকথার উল্লেখ করেছেন। এই চড়া প্রায় তিন মাইল দীর্ঘ ও অাধ মাইল প্রস্থ ছিল। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর 'পরিব্রাজক' গ্রন্থে লিখেছেন "নীচে মহাভয় James and Merry চড়া। পূর্বে দামোদর নদ কলকাতার ৩০ মাইল উপরে গঙ্গায় এসে পড়ত।এখন কালের বিচিত্র গতিতে তিনি ৩১ মাইলের উপর দক্ষিণে এসে হাজির। তার প্রায় ৬ মাইল নীচে রূপনারায়ণ জলকাদা ঢালছেন, মণিকাঞ্চন যোগে তাঁরা তো হুড়মুড়িয়ে আসুন,কিন্তু এ কাদা ধোয় কে?কাজেই রাশীকৃত বালি। সে স্তুপ কখন এখানে, কখন ওখানে,কখন একটু শক্ত,কখন বা নরম হচ্চেন।সে ভয়ের সীমা কি!দিন রাত তার মাপজোখ হচ্ছে, একটু অন্যমনস্ক হলেই --দিন কতক মাপজোখ ভুললেই জাহাজের সর্বনাশ। সে চড়ায় ছুঁতে না ছুঁতেই অমনি উলটে ফেলা,না হয় সোজাসুজিই গ্রাস!! এমনও হয়েছে,মস্ত তিন মাস্তুল জাহাজ লাগবার আধ ঘন্টা বাদেই খালি একটু মাস্তুল মাত্র জেগে রইলেন। এ চড়া দামোদর রূপনারায়ণের মুখই বটেন। দামোদর এখন সাঁওতালি গাঁয়ে তত রাজি নন,জাহাজ স্টীমার প্রভৃতি চাটনি রকমে নিচ্চেন।১৮৭৭খ্রীঃ অব্দে কলকেতা থেকে ' কাউন্টি অফ স্টারলিং ' নামক এক জাহাজে ১৪৪৪ টন গম বোঝাই নিয়ে যাচ্ছিল। ঐ বিকট চড়ায় যেমন লাগা আর তার আট মিনিটের মধ্যেই ' খোঁজ খবর নাহি পাই'।১৮৭৪ খ্রীঃ ২৪০০ টন বোঝাই একটি স্টীমারের দুমিনিটের মধ্যে ঐ দশা হয়। ধন্য মা তোমার মুখ !"
এখানকার অন্যতম স্থাপত্য হল ' ফোর্ট মর্নিংটন পয়েন্ট ' নামের একটি ভগ্ন দুর্গ যা রূপনারায়ণ টুরিস্ট লজের ( অতীতে এই স্থানে বিশালক্ষ্মী রাইস মিল ছিল এবং বর্তমানে এর প্রধান প্রবেশ পথের ডানদিকের স্থাপত্যটি Heritage building এর মর্যাদা পেয়েছে ) সামনে নদীর পাড় থেকে ২৫ মিটার পূর্বে অবস্থান করছে।




অনুমান করা হয়, শত্রুর রণতরীকে কামানের পাল্লার ভিতর রাখবার জন্য সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই স্থানে লর্ড ক্লাইভ দুর্গটি নির্মাণ করেন।লর্ড ক্লাইভ-এর প্রথম শাসনকাল ১৭৫৬-১৭৬০ সাল।এরপর তিনি স্বদেশে ফিরে যান।কিন্তু ১৭৬৫ সালে মীরজাফরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নাজিম- উদ্-দৌলাকে কোম্পানি সিংহাসনে বসালেও তাঁর কর্মচারীদের দূর্নীতির কারণে সর্বত্র বিশৃঙ্খলা প্রবলভাবে দেখা দেয়। কোম্পানির ভাঁড়ারে রাজস্বেও টান পড়ে। এমতাবস্থায় কোম্পানি ক্লাইভকে দ্বিতীয় বার ভারতে নিয়ে এসে বাংলার গভর্নর নিযুক্ত করে পাঠান(১৭৬৫-১৭৬৭)।এই পর্বেই দুর্গটি নির্মিত বলে অনেকে মনে করেন।তবে দুর্গটির এরূপ নামকরণের কারণ অস্পষ্ট। ব্রিটিশ শাসনে Rechard Colley Wesley -কে 'The Earl of Mornington ' বলা হত।কিন্তু তিনি বাংলার গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন ১৭৯৮ থেকে ১৮০৫ সাল পর্যন্ত। লর্ড ক্লাইভের মৃত্যু হয় ১৭৭৫ সালে।সুতরাং তাঁর পক্ষে এই নামকরণ করা অসম্ভব ।হতে পারে 'মর্নিংটন 'নামটি অনেক পরে করা হয়েছে। অবশ্য স্থানীয় প্রবীন মানুষদের বংশপরম্পরায় বাহিত ধারণা অনুযায়ী, এটি ক্লাইভের অনেক অাগে নির্মিত একটি বিশ্রামাগার । মুসলিম শাসনে বেতড় থেকে তাম্রলিপ্ত যাওয়ার পথে জাহাজ নোঙর করে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য চুন,সুরকি ও মোটা মজবুত কাঠ দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছিল। ব্রিটিশ আমলে সেটাই সংস্কার করে গোপন দুর্গ বানানো হয়,যা পরে 'ফোর্ট মর্নিংটন পয়েন্ট 'নামে পরিচিতি লাভ করে।১৯৪২ সালের ভয়ঙ্কর বন্যায় দুর্গটি বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।স্থানীয় মানুষেরা ধ্বংসস্তুপ থেকে অনেক ইট,কাঠ নিয়ে চলে যায়। বর্তমানে শুধুমাত্র ভাঁটার সময় ইটের লম্বা সুড়ঙ্গ পথ সহ নিমজ্জিত দুর্গের বিভিন্ন অংশ দেখা যায়।



এর ২৫ মিটার উত্তর পশ্চিমে ইট ও চুন সুরকি দিয়ে তৈরী, চতুষ্কোণ, ওপরের দিকে ক্রমশ সরু, নাতিদীর্ঘ একটি ভগ্নপ্রায় লাইট হাউসও রয়েছে যা হয়তো আর কয়েকবছর পরে কালের করাল গ্রাসে হারিয়ে যাবে।



*********
তথ্যসূত্রঃ
১. ৫০০ বছরের হাওড়া-হেমেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,১৯৯২
২. বাঙ্গালীর ইতিহাস (অাদি পর্ব)- ১ম -খন্ড -নীহার রঞ্জন রায়, ১৩৫৯
৩. হাওড়া জেলার ইতিহাস -২য় খন্ড - অচল ভট্টাচার্য, ১৯৮২
৪. হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৭৬
৫. হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার - অমিয় কুমার ব্যানার্জী,১৯৭২
৬. বিবেকানন্দ সমগ্র - ১ম খন্ড, ১৯৯৭
অনুসন্ধানে - আশিস চক্রবর্তীঅমলেন্দু বেরা
প্রকাশিত - 'প্রতিদিনের গেরো ' পাক্ষিক পত্রিকা( ১৫ আগষ্ট ২০০৭)

দশম পর্বঃ জাল্লাবাজের কথা (Jallabaz-er katha)

✍️   আশিস চক্রবর্তী  ও  অমলেন্দু বেরা হাওড়া জেলার দক্ষিনে শ্যামপুর থেকে গাদিয়াড়া সড়কের মধ্যে অবস্থিত গুজারপুর বাসস্টপ থেকে আড়াই কি. মি. দূরে...