✍️ আশিস চক্রবর্তী ও অমলেন্দু বেরা
হাওড়া জেলার দক্ষিনে শ্যামপুর থেকে গাদিয়াড়া সড়কের মধ্যে অবস্থিত গুজারপুর বাসস্টপ থেকে আড়াই কি. মি. দূরে জাল্লাবাজ গ্রাম(২২.২৪° উত্তর, ৮৮.০২° পূর্ব)। গ্রামটির পূর্বে নাম ছিল জাল্লাবাদ। পরে হোরমিলার কোম্পানির স্টীমার চলার সময় নাম হয়েছিল জাহানাবাদ। তারও পরে নামটি পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান নামটি আসে। এরূপ নামকরণের কারণ প্রসঙ্গে জানা যায়, গ্রামের অধিকাংশ অধিবাসীর জীবিকা নদীনির্ভর। তারা জাল ও নৌকা সহযোগে মাছ ধরে।এই জাল+ নৌকা>না > লা অর্থাৎ 'জাল্লা' শব্দের উৎপত্তি। সেখান থেকেই ' জাল্লাবাজ ' কথাটি এসেছে।
গ্রামে একটি শীতলা মন্দির আছে যা ১২০৮ বঙ্গাব্দের ২০ আষাঢ় প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান মন্দিরের সামনের দেওয়ালে উৎকীর্ণ ফলকে এর উল্লেখ রয়েছে। মন্দির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, গ্রামের ফতুরাম মাজি নিকটবর্তী রূপনারায়ণ নদীতে স্নান করতে গিয়ে একটি শিলা পান। তিনিই সেটিকে শীতলা রূপে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটি প্রথমে মাটির দেওয়াল ও খড়ের ছাউনি ছিল, বর্তমানে( ১৪২২ বঙ্গাব্দ) তা কংক্রিটের করা হয়েছে।
মন্দিরে শীতলা দেবী ছাড়াও মনসা, ষষ্ঠী, পঞ্চানন্দ, কালু রায়, রূপ রায়, জ্বরাসুরের কংক্রিটের মূর্তি রয়েছে। বর্তমান শীতলা মন্দির ও ভিতরের কংক্রিটের মূর্তিগুলি নির্মাণ করেছেন মায়াচরের শিল্পী অরুণ সামন্ত। এছাড়াও মন্দিরে একটি টেরাকোটার মুন্ডমূর্তি আছে যা মনসা দেবী এবং একটি ডিম্বাকার শিলা(?) বিগ্রহ যা পঞ্চানন্দ হিসেবে পূজিত হচ্ছেন। এই মূর্তিগুলিও ফতুরাম মাজী নদী থেকেই উদ্ধার করেছিলেন বলে জানা যায়। গ্রামের তৎকালীন পত্তনিদার কান্তমোহন মল্লিক মন্দিরের নামে ৮ বিঘা জমি দান করেন। শীতলা মন্দিরের পূর্ব দিকে বাণেশ্বর শিবমন্দির রয়েছে।
মন্দিরে শীতলা দেবী হিসেবে পূজিত মূর্তিটি মেটে সিঁদুর চর্চিত হওয়ার কারণে অস্পষ্ট। সেটি একটি অর্ধবৃত্তাকার পটভূমির উপর খোদিত অবয়ব। শীতলা লৌকিক দেবী ; আর্য- অনার্য সংস্কৃতির সম্মিলনের যুগে পুরাণে গৃহীত হয়ে পৌরাণিক দেবীতে পরিণত হয়েছেন। গাধা বাহনে আসীন দেবী দ্বিভূজা।তাঁর একহাতে পূর্ণ কলস আর হাতে ঝাঁটা। কথিত আছে, কলসের অমৃতময় জল ছিটিয়ে বসন্ত রোগের জ্বালা থেকে মুক্ত করে শীতল করেন বলেই তিনি শীতলা।শীতলার প্রাচীন ভাস্কর্য পাওয়া যায় না, শিলাখন্ড হিসেবে বা অনেক পরবর্তী কালে মাটি বা কাঠ বা কংক্রিটের বিগ্রহ হিসেবে প্রায় সর্বত্র পূজিত হন। বৌদ্ধ দেবী হারিতির অবয়বের সঙ্গে মিল থাকায় হারিতির প্রাচীন প্রস্তর মূর্তিকে অনেকে শীতলা বলে ভুল করেন। তবে এই উভয় দেবীই দ্বিভূজা। জাল্লাবাজের শীতলা মন্দিরে রক্ষিত মূর্তিটি কি কোনো চতুর্ভুজ দেবীর বা দেবতার? কারণ মূর্তিটিতে উপরের দিকে দুটি বাহু ইংরেজি V অক্ষরের মতো উত্থিত,যা অনেকটা দন্ডায়মান বিষ্ণুমূর্তির রূপকে স্মরণ করায়। বিগ্রহের নিচের দিকের অংশ আরও অস্পষ্ট। নিম্নতলের ঠিক উপরে সামনের দিকে সামান্য বেরিয়ে থাকা সূচালো অংশ কি কোনো বাহন ? মনে রাখা প্রয়োজন, ফতুরামবাবু রূপনারায়ণ থেকে প্রায় ২২০ বছর আগে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন এই মূর্তি। অতীতে বিভিন্ন সময়ে রূপনারায়ণের বিশেষত পূর্ব তীর থেকে অনেক প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে। যেমন- সামতাবেড়িয়া (বিষ্ণু- বাসুদেব মূর্তি), খালোড় (বিষ্ণুমূর্তি), বাগনান-হরিনারায়ণপুর (বাসুদেবমূর্তি, মহিষমর্দিনী মূর্তি), বাছরি (বিষ্ণুমূর্তি, বিষ্ণুপট্ট), শ্যামপুর হরিনারায়ণপুর (বৌদ্ধ তারা মূর্তি), আমবেড়ে (দক্ষিণ রায়ের শিলা পিতলের কৌটায় যা বৌদ্ধ চৈতের ক্ষুদ্র সংস্করণ), দেউলি (বিষ্ণুমূর্তি), নুনেবাড় (বিষ্ণুমূর্তি), রাধাপুর (রোমান রণদেবতা জানুস-এর মূর্তি), পিছলদহ (নৃসিংহমূর্তি ও টেরাকোটার মুন্ড)। এই মূর্তিগুলি খ্রিস্টীয় ১১-১২ শতকের পাল- সেন যুগের। হিউএন সাং- এর বিবরণ অনুযায়ী, প্রাচীন তাম্রলিপ্ত রাজ্যটির আয়তন ছিল ১৪০০-১৫০০ লি।কানিংহামের মতে ৬ লিতে ১ মাইল হয়। অর্থাৎ প্রায় ৪০০ কি. মি. বিস্তৃত ছিল সেই বাণিজ্য নগরী। প্রাজ্ঞ ক্ষেত্রসমীক্ষক শিবেন্দু মান্নার মতে "সুপ্রাচীন তাম্রলিপ্ত সভ্যতা ও সংস্কৃতি বলয়ের মধ্যে বর্তমান কালের শ্যামপুর ও বাগনান এলাকার অন্তর্ভুক্তি সুনিশ্চিত।"
মন্দিরে মনসা দেবী হিসেবে পূজিত সম্ভবত টেরাকোটার তৈরি প্রায় গোলাকার মুখাবয়ব এবং পঞ্চানন্দ হিসেবে পূজিত কূর্মাকৃতির ভাস্কর্য ( শিলা?) কি আসলে ধর্মঠাকুরের বিগ্রহ? সিঁদুর চর্চিত হওয়ার কারণে দুটো বিগ্রহই বর্তমানে অস্পষ্ট। সাধারণত মুখাবয়ব বা মুন্ডমূর্তির চোখ হয় টানা টানা, নাক টিকালো ও কানে বৃত্তাকার অলঙ্কার থাকে। আবার কূর্মাকৃতির উত্তল শিলাখন্ডে অনেকসময় পদ্ম বা পদচিহ্ন অঙ্কিত থাকে। কিন্তু উপরোক্ত বিগ্রহগুলিতে দীর্ঘদিন ধরে সিঁদুর লেপনের ফলে সেসব বৈশিষ্ট্য আজ আর বোঝার কোনো উপায় নেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ধর্মঠাকুরের চারধরণের রূপের পুজো প্রচলিত। তার মধ্যে --
ক) বর্গাকার বা আয়তাকার পাথরের পিঁড়ি যার উপর কূর্ম বা পদচিহ্ন অঙ্কিত (কোটরা, দেশান্তরী)
খ) গোলাকৃতি বা কূর্মাকৃতি বা শিবলিঙ্গাকৃতির শিলাখন্ড (ধান্দালী)
গ) পুরুষ প্রতিমা ( নড়াইল)
ঘ) মুন্ডমূর্তি (কাঁঠালদহ,বাসুদেবপুর)
মন্দিরের এই তিনটি বিগ্রহই ডুগডুগির আদলে তৈরি প্রায় ১ ফুট দৈর্ঘ্যের টেরাকোটার বেদীর উপর সুপ্রতিষ্ঠিত।
যেসময় ঘাটাল থেকে আরমেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত হোরমিলার কোম্পানির স্টীমার চলত সেই সময় এই গ্রামের তেঁতুলতলা নামক স্থানে স্টীমার ঘাট ছিল।উল্লেখ্য, এই ঘাট থেকে স্টীমার আড়াআড়ি ভাবে রূপনারায়ণ নদ পার হয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের বাঁকাতে (দনিপুর) যাতায়াত করত।তখন এই অংশের দূরত্ব ছিল ৮.৫ কি.মি.। পরবর্তীকালে চর পড়ে যাওয়ার জন্য শিবপুরের পুরনো হাটের কাছে স্টীমার ঘাট তৈরী হয়।
*****
তথ্য সূত্র -
১. হাওড়া ইতিহাস ও ঐতিহ্য - শিবেন্দু মান্না
২.বৌদ্ধদের দেবদেবী - ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্য
৩.বাংলার লৌকিক দেবতা- গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু
প্রকাশিতঃ 'প্রতিদিনের গেরো' পত্রিকা, ১ জানুয়ারি, ২০০৮