Wednesday, January 19, 2022

দশম পর্বঃ জাল্লাবাজের কথা (Jallabaz-er katha)

✍️ আশিস চক্রবর্তী ও অমলেন্দু বেরা

হাওড়া জেলার দক্ষিনে শ্যামপুর থেকে গাদিয়াড়া সড়কের মধ্যে অবস্থিত গুজারপুর বাসস্টপ থেকে আড়াই কি. মি. দূরে জাল্লাবাজ গ্রাম(২২.২৪° উত্তর, ৮৮.০২° পূর্ব)। গ্রামটির পূর্বে নাম ছিল জাল্লাবাদ। পরে হোরমিলার কোম্পানির স্টীমার চলার সময় নাম হয়েছিল জাহানাবাদ। তারও পরে নামটি পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান নামটি  আসে। এরূপ নামকরণের কারণ প্রসঙ্গে জানা যায়, গ্রামের অধিকাংশ অধিবাসীর জীবিকা নদীনির্ভর। তারা  জাল ও নৌকা সহযোগে মাছ ধরে।এই  জাল+ নৌকা>না > লা অর্থাৎ 'জাল্লা' শব্দের উৎপত্তি। সেখান থেকেই ' জাল্লাবাজ ' কথাটি এসেছে। 

গ্রামে একটি শীতলা মন্দির আছে যা ১২০৮ বঙ্গাব্দের ২০ আষাঢ় প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান মন্দিরের সামনের দেওয়ালে উৎকীর্ণ ফলকে এর উল্লেখ রয়েছে। মন্দির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, গ্রামের ফতুরাম মাজি নিকটবর্তী রূপনারায়ণ নদীতে স্নান করতে গিয়ে একটি শিলা পান। তিনিই সেটিকে শীতলা রূপে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটি প্রথমে মাটির দেওয়াল ও খড়ের ছাউনি ছিল, বর্তমানে( ১৪২২ বঙ্গাব্দ)  তা কংক্রিটের করা হয়েছে।


   মন্দিরে শীতলা দেবী ছাড়াও মনসা, ষষ্ঠী, পঞ্চানন্দ, কালু রায়, রূপ রায়, জ্বরাসুরের কংক্রিটের  মূর্তি রয়েছে। বর্তমান শীতলা মন্দির ও ভিতরের কংক্রিটের মূর্তিগুলি নির্মাণ করেছেন মায়াচরের শিল্পী অরুণ সামন্ত। এছাড়াও মন্দিরে  একটি টেরাকোটার মুন্ডমূর্তি আছে  যা মনসা দেবী এবং একটি ডিম্বাকার শিলা(?) বিগ্রহ যা পঞ্চানন্দ  হিসেবে পূজিত হচ্ছেন। এই মূর্তিগুলিও ফতুরাম মাজী নদী থেকেই উদ্ধার করেছিলেন বলে জানা যায়। গ্রামের তৎকালীন পত্তনিদার কান্তমোহন মল্লিক মন্দিরের নামে ৮ বিঘা জমি দান করেন। শীতলা মন্দিরের পূর্ব দিকে বাণেশ্বর শিবমন্দির রয়েছে। 

মন্দিরে শীতলা দেবী হিসেবে পূজিত মূর্তিটি মেটে সিঁদুর চর্চিত হওয়ার কারণে অস্পষ্ট। সেটি একটি অর্ধবৃত্তাকার পটভূমির উপর খোদিত অবয়ব। শীতলা লৌকিক দেবী ; আর্য- অনার্য সংস্কৃতির সম্মিলনের যুগে পুরাণে গৃহীত হয়ে পৌরাণিক দেবীতে পরিণত হয়েছেন। গাধা বাহনে আসীন দেবী দ্বিভূজা।তাঁর একহাতে পূর্ণ কলস আর হাতে ঝাঁটা। কথিত আছে, কলসের অমৃতময় জল ছিটিয়ে বসন্ত রোগের জ্বালা থেকে মুক্ত করে শীতল করেন বলেই তিনি শীতলা।শীতলার প্রাচীন ভাস্কর্য পাওয়া যায় না, শিলাখন্ড হিসেবে বা অনেক পরবর্তী কালে মাটি বা কাঠ বা কংক্রিটের বিগ্রহ হিসেবে প্রায় সর্বত্র পূজিত হন। বৌদ্ধ দেবী হারিতির অবয়বের সঙ্গে মিল থাকায় হারিতির প্রাচীন প্রস্তর মূর্তিকে অনেকে শীতলা বলে ভুল করেন। তবে এই উভয় দেবীই দ্বিভূজা। জাল্লাবাজের শীতলা মন্দিরে রক্ষিত মূর্তিটি কি কোনো চতুর্ভুজ দেবীর বা দেবতার? কারণ  মূর্তিটিতে উপরের দিকে দুটি বাহু ইংরেজি  V অক্ষরের মতো উত্থিত,যা  অনেকটা দন্ডায়মান বিষ্ণুমূর্তির রূপকে স্মরণ করায়। বিগ্রহের নিচের দিকের অংশ আরও অস্পষ্ট। নিম্নতলের  ঠিক উপরে সামনের দিকে সামান্য বেরিয়ে থাকা সূচালো অংশ কি কোনো বাহন ? মনে রাখা প্রয়োজন, ফতুরামবাবু রূপনারায়ণ থেকে প্রায় ২২০ বছর আগে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন এই মূর্তি। অতীতে বিভিন্ন সময়ে রূপনারায়ণের বিশেষত পূর্ব তীর থেকে অনেক প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে। যেমন- সামতাবেড়িয়া (বিষ্ণু- বাসুদেব মূর্তি), খালোড় (বিষ্ণুমূর্তি), বাগনান-হরিনারায়ণপুর (বাসুদেবমূর্তি, মহিষমর্দিনী মূর্তি), বাছরি (বিষ্ণুমূর্তি, বিষ্ণুপট্ট), শ্যামপুর হরিনারায়ণপুর (বৌদ্ধ তারা মূর্তি), আমবেড়ে (দক্ষিণ রায়ের শিলা পিতলের কৌটায় যা বৌদ্ধ চৈতের ক্ষুদ্র সংস্করণ), দেউলি (বিষ্ণুমূর্তি), নুনেবাড় (বিষ্ণুমূর্তি), রাধাপুর (রোমান রণদেবতা জানুস-এর মূর্তি), পিছলদহ (নৃসিংহমূর্তি ও টেরাকোটার মুন্ড)। এই মূর্তিগুলি খ্রিস্টীয় ১১-১২ শতকের পাল- সেন যুগের।  হিউএন সাং- এর বিবরণ অনুযায়ী, প্রাচীন তাম্রলিপ্ত রাজ্যটির আয়তন ছিল ১৪০০-১৫০০ লি।কানিংহামের মতে ৬ লিতে ১ মাইল হয়। অর্থাৎ প্রায় ৪০০ কি. মি. বিস্তৃত ছিল সেই বাণিজ্য নগরী। প্রাজ্ঞ ক্ষেত্রসমীক্ষক শিবেন্দু মান্নার মতে "সুপ্রাচীন তাম্রলিপ্ত সভ্যতা ও সংস্কৃতি বলয়ের মধ্যে বর্তমান কালের শ্যামপুর ও বাগনান এলাকার অন্তর্ভুক্তি সুনিশ্চিত।"

মন্দিরে মনসা দেবী হিসেবে পূজিত সম্ভবত টেরাকোটার তৈরি প্রায় গোলাকার মুখাবয়ব এবং পঞ্চানন্দ হিসেবে পূজিত কূর্মাকৃতির ভাস্কর্য ( শিলা?) কি আসলে  ধর্মঠাকুরের বিগ্রহ?  সিঁদুর চর্চিত হওয়ার কারণে দুটো বিগ্রহই বর্তমানে অস্পষ্ট। সাধারণত মুখাবয়ব বা মুন্ডমূর্তির চোখ হয় টানা টানা, নাক টিকালো  ও কানে বৃত্তাকার অলঙ্কার থাকে। আবার কূর্মাকৃতির উত্তল শিলাখন্ডে অনেকসময় পদ্ম বা পদচিহ্ন অঙ্কিত থাকে। কিন্তু উপরোক্ত বিগ্রহগুলিতে দীর্ঘদিন ধরে সিঁদুর লেপনের ফলে সেসব বৈশিষ্ট্য আজ আর বোঝার কোনো উপায় নেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,  ধর্মঠাকুরের চারধরণের রূপের পুজো প্রচলিত। তার মধ্যে --

ক) বর্গাকার বা আয়তাকার পাথরের পিঁড়ি যার উপর কূর্ম বা পদচিহ্ন অঙ্কিত (কোটরা, দেশান্তরী) 

খ) গোলাকৃতি বা কূর্মাকৃতি বা শিবলিঙ্গাকৃতির শিলাখন্ড (ধান্দালী)

গ) পুরুষ প্রতিমা ( নড়াইল) 

ঘ) মুন্ডমূর্তি (কাঁঠালদহ,বাসুদেবপুর) 

মন্দিরের এই তিনটি বিগ্রহই ডুগডুগির আদলে তৈরি প্রায় ১ ফুট দৈর্ঘ্যের টেরাকোটার বেদীর উপর সুপ্রতিষ্ঠিত। 

যেসময় ঘাটাল থেকে আরমেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত হোরমিলার কোম্পানির স্টীমার চলত সেই সময় এই গ্রামের তেঁতুলতলা নামক স্থানে স্টীমার ঘাট ছিল।উল্লেখ্য, এই ঘাট থেকে স্টীমার আড়াআড়ি ভাবে রূপনারায়ণ নদ পার হয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের বাঁকাতে (দনিপুর) যাতায়াত করত।তখন এই অংশের দূরত্ব ছিল ৮.৫ কি.মি.। পরবর্তীকালে চর পড়ে যাওয়ার জন্য শিবপুরের পুরনো হাটের কাছে স্টীমার ঘাট তৈরী হয়।

 *****

তথ্য সূত্র -

১. হাওড়া ইতিহাস ও ঐতিহ্য - শিবেন্দু মান্না

২.বৌদ্ধদের দেবদেবী - ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্য 

৩.বাংলার লৌকিক দেবতা- গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু

প্রকাশিতঃ 'প্রতিদিনের গেরো' পত্রিকা, ১ জানুয়ারি, ২০০৮

Saturday, February 13, 2021

নবম পর্বঃ ডিহি মন্ডলঘাট (Dihi Mondalghat)

 ✍️ আশিস চক্রবর্তীঅমলেন্দু বেরা

হাওড়া জেলার দক্ষিণে শ্যামপুর থানার অন্তর্গত ডিহি মন্ডলঘাট গ্রামের (২২.২৯°উত্তর ৮৭.৯৬° পূর্ব) ঐতিহাসিকতা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। 'ডিহি' ফারসি শব্দ যার অর্থ তালুক বা ছোট জমিদারি বা কয়েকটি  মৌজার সমষ্টি। ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৫৮২ খ্রীষ্টাব্দে টোডরমলের রাজস্ব এলাকা বিভাগের সময় বর্তমান হাওড়া জেলার সমগ্র অংশ সুবা বাংলার যে তিনটি 'সরকার'-এ (সাতগাঁ, সুলিয়ামানাবাদ এবং মান্দারন) বিভক্ত করা হয়, তার মধ্যে মান্দারন সরকারের অন্তর্গত ছিল মন্ডলঘাট পরগণা।  অবশ্য আইন-ই-আকবরীতে বলা হয়েছে, প্রথমদিকে মন্ডলঘাট ছিল সরকার মান্দারনের একটি 'মহল' মাত্র, পরে পরগণায় রূপান্তরিত হয়। মুর্শিদকুলি খাঁর শাসনতান্ত্রিক সংস্কারে ১০০ গ্রামে ১টি পরগণা হত।পরগণাগুলির মধ্যে মন্ডলঘাট ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর  আয়তন ছিল ১,৭৮,৭৫৬ একর বা ২৭৯.৩১ বর্গমাইল। জনসংখ্যা ১,৪২,৬৬৬। ১৭০৩ সালে জন থর্ণটন কৃত পাইলট চার্টে দামোদর নদকে 'মন্ডলঘাট নদ' হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে। তার কারণ হয়তো গুরুত্বপূর্ণ  এই  পরগণার মধ্যে দিয়ে দামোদর  নদের নিম্নগতি প্রবাহ। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাম্রলিপ্ত বন্দরের সঙ্গে এই মন্ডলঘাট পরগণার আদান-প্রদান চলত। আইন-ই-আকবরী অনুসারে মন্ডলঘাট পরগনার রাজস্ব ছিল ৯,০৬,৭৭৫ দাম।

এই  'মন্ডলঘাট' নামকরণ প্রসঙ্গে বলা যায়, সেন বংশের বিখ্যাত রাজা ছিলেন বল্লাল সেন। তাঁর একজন মহামান্ডলিক  বর্তমান দাসপুর থানার (পূর্ব মেদিনীপুর) মহিষঘাটার অধিবাসী মহেশ মন্ডল। তাঁরই নামানুসারে এই মন্ডলঘাট পরগনার নামকরণ।

বর্তমান ডিহি মন্ডলঘাট গ্রামটি উক্ত পরগণার কেন্দ্র ছিল বলে মনে হয়। বৃটিশ আমলে  রূপনারায়ণ তীরবর্তী এ অঞ্চলটি Tamluk Salt Agent - এর অন্তর্গত লবন উৎপাদন ও বাণিজ্যের আড়তে পরিণত হয়েছিল বলে জানা যায়।

গ্রামের অন্যতম পুরাকীর্তি হল দক্ষিণাকালীর ত্রিখিলান অলিন্দযুক্ত দালান মন্দির।মন্দিরটি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে প্রায় ২০'৬" (৬.৩ মি.) এবং উচ্চতায় ১২' (৩.৭ মি.)। চতুর্ভুজা দেবীর কালো কষ্টিপাথরের বিগ্রহটি মন্দিরের ডানদিকের পুকুর ( যা এলাকায় 'কালিদহ' নামে পরিচিত) খননের সময় পাওয়া যায়, যার উচ্চতা আনুমানিক ১৫ সেমি.  ও প্রস্থ ৭.৫ সেমি.। জনশ্রুতি, মন্দিরের বর্তমান সেবায়েত ঘোষাল পরিবারের পূর্বপুরুষ জনৈক দুর্গাপদ ঘোষালের বিধবা মাকে দেবী স্বপ্নাদেশ করেন এবং তারপর মন্দির নির্মাণ করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাগনানের খালোড় কালীমন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা স্থানীয়  ভূস্বামী  কন্দর্পনারায়ণ মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন বলে কথিত আছে, যদিও এই কন্দর্পনারায়ণ সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাওয়া যায় না। সেবায়েতদের অভিমত অনুযায়ী, একসময় বর্ধমানের রাজা মন্দিরের নামে বেশ কিছু জমি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে দান করেছিলেন যার অধিকাংশই বর্তমানে দখলদারির কারণে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে।


মন্দিরে একটি প্রাচীন পশুবলির খাঁড়া রয়েছে যার গায়ে বঙ্গাক্ষরে '১০৮১ সাল' খোদিত ছিল, তবে মরিচা পড়ায় এখন আর তা স্পষ্ট নয়। ঐ খাঁড়ায় পশুবলি হয় না, বলির জন্য আলাদা খাঁড়া ব্যবহৃত হয়। দেবী প্রথমে চন্দনকাঠের সিংহাসনে অধিষ্ঠিতা ছিলেন। প্রায় ৮০ বছর আগে তাতে আগুন লেগে পুড়ে যায়। বর্তমানের সিংহাসনটি সেই সময়ের তৈরী।

সুদূর অতীতে এ অঞ্চলে যে একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল, তার প্রমাণ রয়েছে। অতীতে মন্দির সংলগ্ন কালিদহ পুকুরে খননের সময় নললাগানো বিভিন্ন ধরনের পোড়ামাটির পাত্র পাওয়া গিয়েছিল। স্থানীয় বেরা পরিবারের পুকুর খুঁড়তে গিয়ে পোড়ামাটির বেড় দেওয়া পাতকুয়া এবং ইটের রাস্তাও পাওয়া গিয়েছিল বলে স্থানীয় প্রবীণদের মত। তবে শুধুমাত্র এই গ্রামেই নয়, রূপনারায়ণ ও দামোদর নদ তীরবর্তী সমগ্র শ্যামপুরে বিভিন্ন স্থানে খুঁড়তে গিয়ে প্রাচীন মূর্তি ও মৃৎপাত্র পাওয়া গিয়েছে একাধিক বার। যথাযথ অনুসন্ধান চালালে হয়তো আরও অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে। কালীমন্দিরের কাছে  যেখানে হাট বসে তার পাশে বটগাছের তলায় কয়েকটি সিঁদুর মাখানো নুড়ির সাথে একটি পোড়ামাটির অদ্ভুত দর্শন মুখাবয়ব দেবী ষষ্ঠী হিসেবে পূজিত হতেন যার সঙ্গে দক্ষিণ ২৪ পরগণার বারা ঠাকুরের (দক্ষিণ রায় ও নারায়ণী)  আদলের মিল ছিল। তবে সাম্প্রতিক আমফান বিপর্যয়ে বটগাছটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মুখাবয়বটি ভেঙে টুকরো হয়ে যায়।

গ্রামের বনেদি বংশ হল বিশ্বাস ও বেরা।  এখন যেখানে ডিহিমণ্ডলঘাট হাইস্কুল  অবস্থিত, পূর্বে সেখানে পত্তনিদার বিশ্বাসদের  কাছারি বাড়ি ছিল। তারই নিকটে আনুমানিক ১৫০ বছর পূর্বে সীতাপতি বিশ্বাসের পূর্বপুরুষ রামলাল বিশ্বাস পশ্চিমমুখী কমলেশ্বর শিবমন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।  দৈর্ঘ্য প্রস্থে ১২'৩" (৩.৭ মি.) এবং প্রায় ৩০'(৯.২ মি.) উচ্চতা বিশিষ্ট এই মন্দিরের গর্ভগৃহের ছাদ চার দেওয়ালের কোনে উদ্গত লহরা নির্ভর গম্বুজের উপর স্থাপিত। পূর্বে সামনের দেওয়ালে পঙ্খের অলংকরণ ছিল কিন্তু বর্তমানে তার কোনও চিহ্ন নেই। পাশের রাস্তা থেকে প্রায় ১০ ফুট উঁচু ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরের নোনাধরা দেওয়ালে কালের থাবা স্পষ্ট। এখানে ওখানে গাছ ও লতা গজিয়ে উঠেছে। বিশেষত নিচের দিকের বিভিন্ন অংশ থেকে ইট খসে পড়ছে। যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে  পুরাতত্ত্বের এমন অনবদ্য নিদর্শনটি সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যাবে।

গ্রামের শীতলা মন্দিরটি  কালীমন্দিরের সমসাময়িক। ঘটের উপর শিলা দেবী রূপে পূজিত হন।  প্রতিষ্ঠাতা রাজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নামের জনৈক তান্ত্রিক। জনশ্রুতি অনুযায়ী, বর্তমান বাঁধানো বকুল গাছের পাশে কুটিরে তিনি থাকতেন। প্রথমে মন্দিরটি মাটির দেওয়াল, তালপাতার ছাউনি ছিল। বর্ধমানের মহারাজ একবার বেড়াতে এসে ঐ তান্ত্রিককে মদনমোহনজীর একটি পেতলের মূর্তি ও ৩২ বিঘা জমি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে দান করেন। আন্টিলাপাড়ার জনৈক বিন্দুবাসিনী দেবী এ মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর স্থানীয় মাজি বংশের কর্তারা পার্শ্ববর্তী  বরদাবাড় গ্রামের হরিপদ মিশ্রকে পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত করেন। সেই থেকে তাঁর উত্তরসূরীরা পূজা করে আসছেন। ৬০ বছর আগে মদনমোহন মূর্তিটি চুরি হয়ে যায়। বর্তমানে মন্দিরে শীতলা দেবী ছাড়াও মনসা, পঞ্চানন্দ, জ্বরাসুর, দক্ষিণরায়, রূপ রায়, পাঁচুগোপাল ও রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ রয়েছে। মাটির মন্দিরটিকে কংক্রিটের তৈরি করে দেন জহরলাল মাজি। নব কলেবর হয় ৪ ঠা মার্চ ১৯৭৬ সালে। এরপর ২০১৯ সালের ৭ মে জহরলাল মাজির উত্তরসূরীরা মন্দিরের সংস্কার করেন।

 *******************


তথ্য সূত্রঃ-
১.হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৭৬
২. হাওড়া জেলার ইতিহাস(২য় খন্ড) -অচল ভট্টাচার্য, ১৯৮২
৩. আইন- ই- আকবরী - আবুল ফজল( অনু. - পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়,২০১৭
৪. Bengal District Gazetteer Howrah - L.S.S. Omalley, 1909
৫.  A Statistical Accounts of Bengal ( vol.- 3) - W.W.Hunter,1875

মানচিত্রঃ-
১. ১৭০৩ সালের ইংলিশ পাইলট চার্ট

Friday, February 5, 2021

অষ্টম পর্বঃ শ্যামপুরে সুফি ধর্ম ও ঐতিহাসিক পীর মাহাত্ম্য


✍️ আশিস চক্রবর্তীঅমলেন্দু বেরা

লৌকিক ইতিহাস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্মৃতিবাহিত। সত্যের সঙ্গে কল্পনার মিশেলে প্রক্ষেপও ঘটেছে তাতে। তাই কিংবদন্তি আর বাস্তবতা ওতোপ্রোতো ভাবে মিশে যায় লোকসংস্কৃতির অন্তর্বয়নে।

হাওড়া জেলার দক্ষিণে শ্যামপুর থানার বিভিন্ন গ্রামে ঐতিহাসিক পীরের পাশাপাশি অনেক কাল্পনিক পীর- পীরানীর থান বা মাজার রয়েছে। যেমন- মানিকপীর, গাজীপীর, ছাবাল পীর, ওলাবিবি, বনবিবি ইত্যাদি হলেন কাল্পনিক পীর। মানিকপীর, ছাবাল পীর, গাজীপীর হলেন গৃহপালিত পশু রক্ষক; বনবিবি বনাঞ্চলের অধিষ্ঠাত্রী; ওলাবিবি কলেরা- হাম-বসন্ত রোগের নিরাময়কারী। আবার সীতাপুর ও বরাগাছি নিকটবর্তী কাশীপুর গ্রামের দেওয়ান বা দাওয়ান বা দাওন পীর, গড়চুমুকের সুজন পীর, বারগ্রামের বড়খান গাজী হলেন ঐতিহাসিক পীর।




নদীমাতৃক শ্যামপুরের ধর্মীয় মানচিত্রে শুধু নয়,সমগ্র ভারত উপমহাদেশেই পীরবাদ হল একটি মুক্ত অসাম্প্রদায়িক লৌকিক মতবাদ যেখানে হিন্দু মুসলমান ও অন্যান্য মতাদর্শের মানুষ নিঃসংকোচে মিলতে পারে।
'পীর' ফারসি শব্দ, যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ 'বয়োজ্যেষ্ঠ'। সম্ভবত পরবর্তী কালে আধ্যাত্মিক গুরু অর্থে এর প্রয়োগ হয়। সুফি ধর্মে গুরুকে বলা হয় পীর এবং তাঁর অনুগামীদের বলা হয় ফকির বা দরবেশ।
দেওয়ান পীরঃ-
শ্যামপুর থানার সীতাপুর ও কাশীপুর গ্রামের যে দুজন পীরের মাজার রয়েছে তাঁরা উভয়েই দেওয়ান পীর নামেই প্রসিদ্ধ। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, জনমানসে উদারনৈতিক ইসলাম ধর্মের প্রচারের জন্য বহু বছর আগে একই পরিবারের সাতভাই হাওড়া ও ২৪ পরগণা জেলায় চলে আসেন। তাঁদের মধ্যে দু'ভাই রয়েছেন সীতাপুর ও কাশীপুরে। তাঁরা কোথা থেকে এসেছিলেন তা জানা যায় না। তবে তাঁরা অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন, নানা জড়িবুটি ও টোটকা সম্পর্কেও ধারণা ছিল তাঁদের। প্রতি বছর ১ লা মাঘ উক্ত স্থানদুটিতে পীরের স্মরণে বিশেষ উৎসব পালিত হয়। ধর্ম বর্ণ জাতি নির্বিশেষে সব মানুষ এই উৎসবে সামিল হন।




শ্যামপুরের দেওয়ান পীরের প্রকৃত নাম কি ছিল তা হয়তো আজ আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে 'দেওয়ান' বা 'দাওয়ান' শব্দের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা যায়। 'বঙ্গীয় শব্দকোষ' অনুযায়ী 'দেওয়ান' হলেন খাজনা আদায়ের প্রধান কর্মচারী। তবে কি এখানকার পীর ইসলামের প্রচারের পাশাপাশি রাষ্ট্রযন্ত্রের অধীনেও কাজ করতেন?
এ প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে পীরবাদের উদ্ভবের ইতিহাসে।
'মূলতঃ দ্বাদশ শতক থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে সুফি ধর্মের প্লাবন আছড়ে পড়ে। বলা হয়ে থাকে যে সুলতানি সাম্রাজ্য স্থাপনের পর ইসলামের অবক্ষয় দেখে কয়েকজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান রাষ্ট্রের সঙ্গে সর্ব প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহ ও মানুষের প্রেমের সম্পর্কের উপর গুরুত্ব স্থাপন করেন। ইসলামের আদর্শের সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতীয় যোগদর্শন, উপনিষদ ও থেরবাদী বৌদ্ধ সংস্কৃতি। সুফি ধর্ম এই রসায়নের ফলশ্রুতি। বিশিষ্ট সুফি বিশেষজ্ঞ নুর রহমান লিখেছেন "The belief in Pirs and worship at their shrines did not originate in India but were brought from Afghanistan, Persia and Iraq by the immigrants, along with their religious orders. But in India in general and Bengal in particular, certain factors facilitated the penetration of the saint worship into Muslim society. Pir worship was a form of joint worship of the Hindus and the Muslims in medieval Bengal." তবে শুধু ইসলাম ও হিন্দু সংস্কৃতি নয়, সুফি মতাদর্শ নির্মাণে বৌদ্ধ প্রভাবও রয়েছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, এক একজন সুফি সাধককে কেন্দ্র করে এক একটি সম্প্রদায় বা সংঘ গড়ে ওঠে । আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে ১৪ টি সুফি সংঘের উল্লেখ রয়েছে। তার মধ্যে ভারতে এসেছিল যে ৪ টি সেগুলি হল চিশতি, সুরাবর্দি, মদানি ও ফিরদৌসী। এদের মধ্যে সুরাবর্দি সম্প্রদায়ের সুফিরা পাঞ্জাব, মুলতান ও বাংলায় প্রভাবশালী ছিলেন। প্রাচীন মদিনা নগরীর সুরাবর্দি নামক এক গ্রাম থেকে 'সুরাবর্দি' শব্দের উৎপত্তি। এই সম্প্রদায়ের সাধকদের মধ্যে শেখ আবু নাজিব আব্দুল কাহির, শেখ শাহাবুদ্দিন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সুরাবর্দি পীরগণ রাজদরবারের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক রাখতেন এবং রাষ্ট্রের অধীনে উচ্চপদ গ্রহন করতেন।হয়তো এই দেওয়ান সাহেব নামে প্রসিদ্ধ সাতজন পীর নবাবের কর্মচারী ছিলেন। তবে প্রকৃত পরিচয় অস্পষ্ট হলেও বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে দ্বাদশ শতক থেকে ইসলামের প্রচারেরর উদ্দেশে মরমিয়াবাদী পীরগণ তথা সুফি সাধকেরা দলবদ্ধ ভাবেই অবিভক্ত বাংলা সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে এসেছিলেন।
আবার পীরের পূজারীকে 'দাওয়ান' বলা হয়। এ প্রসঙ্গে সীতাপুর ও কাশীপুরের মানুষ জন বংশপরম্পরায় যে কিংবদন্তী বহন করে চলেছেন সেটি হল গভীর রাতে সাদা আলখাল্লা পরিহিত পক্ককেশ দাওয়ান নাকি ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ান। অতীতে কেউ কেউ নাকি ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দও শুনেছে। এ কাহিনি অবশ্য প্রায় সমস্ত পীরের মাজারেই প্রচলিত।হয়তো সীতাপুর বা কাশীপুরে তেমনই কোনো দাওয়ান পীরের মর্যাদায় উন্নীত হয়ে থাকবেন।এমন ঘটনা অসম্ভব নয়। কারণ মধযুগের বাংলার ধর্মীয় ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, মুসলমান সেনাপতিগণও যুদ্ধে নিহত হলে গাজীপীর নামে পুজিত হতেন।
আসলে ব্রাহ্মণ্য শাসিত অন্ত্যজ হিন্দু ও সাধারণ মুসলমানের কাছে পীর হলেন অলীক মানুষ। তিনি বাতাসের গতিতে অল্প সময়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে পারেন, অসুখ-বিসুখ সারিয়ে দিতে পারেন,বন্য হিংস্র জীব-জন্তুকে পোষ মানাতে পারেন, দৈব- দুর্বিপাক আগে থেকেই বুঝতে পারেন ইত্যাদি। তাই হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষজন পীর বা পীরের দরগায় মানত করেন বা কবচ-মাদুলি ইত্যাদির সাহায্যে বিপদ এড়াবার প্রয়াস করেন। সাধারণত পৌষ-মাঘ মাসে পীরের থানে উৎসব হয়। বছরের এই সময়টাকে বেছে নেওয়ার কারণ মনে হয়, কৃষিপ্রধান বাংলায় অতীতে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে নিম্নবর্গের দরিদ্র কৃষকেরা এই সময়েই একফসলা জমি থেকে ফসল ঘরে আনত এবং সেটাই ছিল তাদের দিনাতিপাত ও বিনোদনের মূল রসদ।তাই সম্বৎসর পীরবাবা নানা অসুখ বিসুখে যে উপকার করেছেন তার জন্য সাধারণ ভক্তরা তাদের উপার্জিত অন্নের কিছুটা অংশ অর্ঘ্য হিসেবে নিবেদন করত এই সময়ে যা কালক্রমে উৎসবের রূপ নেয়।
স্বয়ং পীর বা পীরের পুজারী মুখ্যত ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও শরিয়ত-কেন্দ্রিক ইসলামের সঙ্গে পীরবাদের প্রভেদ রয়েছে। ইসলাম আল্লাহ্ ব্যতীত আর কাউকেই শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করে না এবং মূর্তি বা প্রতীকের সাধনাকেও নিষিদ্ধ বলে মানে। কিন্তু পীর বাদে এ সব কিছুকেই স্বীকার করা হয়েছে এবং সম্প্রদায়গত আচার-সংস্কারকে বজায় রেখে মৈত্রী ও প্রেমকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছে। সেখানে 'নজরানা', 'মানৎ' যেমন বৈধ, তেমনই কোনো রূপ শাস্ত্র বিধি না মেনে, কোনো মন্ত্র উচ্চারণ না করে কেবল ঐকান্তিক ইচ্ছে ও ভক্তিকে প্রকাশ করা স্বীকৃত। সেখানে পার্থিব জীবনের লৌকিক সুবিধে অসুবিধেগুলোও নিরলঙ্কৃত ও অকৃত্রিম ভাবেই গৃহীত হয়। 'বাবা মঙ্গল কর', 'বাবাসাহেব অসুখ ভালো করে দাও', 'পীরবাবা সন্তুষ্ট হও'.... এইরকম সহজ অনাড়ম্বর উচ্চারণই পূজা। পীরদের সঙ্গে মোল্লাদের অন্যতম পার্থক্য এখানেই। মোল্লারা মুসলমানদের স্বর্গ আর নরকের ভয় দেখিয়ে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু সুফি ধর্মে পীর দরবেশরা ভক্তি ও ভালোবাসার মাধ্যমে ঈশ্বরকে খোঁজার কথা বলেন। গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে সৃষ্টি কর্তা বা আল্লাহ্-এর প্রেমলাভের কথা বলেন। সুফি সাধনায় এটি 'আশুক-মাশুক' তত্ত্ব নামে পরিচিত। 'শুকের' অর্থ যে ভালোবাসে এবং 'মাশুকের' অর্থ যাকে ভালোবাসা যায়। গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনে একেই পক্ষান্তরে 'জীবাত্মা-পরমাত্মা তত্ত্ব' বলা হয়েছে । সুফি সাধক 'ফানাফিল্লাহ' হলে অর্থাৎ আল্লাহ্-এর প্রেম সাধনা করে তাঁর সঙ্গে একাত্ম হলে 'কামেল ইনসান' বা পীর হওয়ার যোগ্য হন। তিনি সব মানুষের মুশকিল আসান; ভক্তি ও ভালোবাসায় মনের মানুষ। ষোড়শ শতকে চৈতন্য এই ভক্তিবাদের জোয়ারেই বাংলাকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন জাতপাতের বাধা ও মন্দিরকেন্দ্রিক প্রাতিষ্ঠানিকতার বেড়াজাল ভেঙে। কবির উচ্চারণ করেছিলেন "ভ্রান্ত গরিমা দরজায় তালা দিয়ে দেয়,ভক্তি আর ভালোবাসার চাবি দিয়েই তাকে খুলতে হয়।" সুফি ধর্মে তাই প্রেমই সত্য।
পূর্বেই বলেছি যে সুফি মতবাদে শুধু ইসলাম ও হিন্দু নয়, বৌদ্ধ সংস্কৃতিরও প্রভাব রয়েছে। প্রথমত, ফারসি 'পীর' শব্দটি বৌদ্ধ 'থের' ( সং-স্থবির) শব্দের হুবহু অনুসরণ; উভয় শব্দেরই অর্থ 'বৃদ্ধ ব্যক্তি'।
দ্বিতীয়ত, পীরের থান হিসেবে বিভিন্ন গ্রামে যে স্থাপত্যটিকে শ্রদ্ধা জানানো হয় তার গঠন অনেকটা শঙ্কু আকৃতির। ভূমি থেকে সামান্য উঁচু বেদীর উপর একটি বা দুটি বা তিনটি মাটি বা কংক্রিটের তৈরি ঢিবি বা স্তুপ। এই স্তুপের ধারণা বৌদ্ধ সংস্কৃতি থেকে আগত। কারণ শুরুতে বৌদ্ধ ধর্ম নিরাকারে বিশ্বাসী হলেও বুদ্ধের মৃত্যুর পর রাজা অজাতশত্রু ও বৈশালী, কপিলাবস্তু, অলকপপ, রাজগ্রাম, বেটদীপ, গাবা ও কুশী নগরের রাজাগন তাঁর দেহাবশেষ নিয়ে গিয়ে আটটি জনপদে আটটি স্তুপ নির্মান করেন। এই স্তুপগুলিই বুদ্ধকে উদ্দেশ্য করে তৈরি বৌদ্ধ ধর্মের প্রথম স্থাপত্য। পরবর্তীকালে প্রবীণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বা প্রধান ভান্তের মৃত্যুর পর তাঁর দেহাবশেষ বা ব্যবহৃত জিনিসকে সংঘের বাকি সদস্যরা স্তুপ করে রাখতে শুরু করেন। একে বলা হয় 'চৈত্য'।এখানেই বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন সময়ে উপস্থিত হয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বা একান্ত নিজস্ব মনোবাসনা ব্যক্ত করেন। পীর ধর্মে এর অনুকরণ দেখা যায়। পীর বা দরবেশদের সমাধি বা স্মৃতি বিজড়িত ভূমিতে একটি স্তুপ নির্মাণ করা হয় তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বা তাঁর কাছে প্রার্থনা করার জন্য। একে বলা হয় মাজার। কোথাও কোথাও এক বা একাধিক প্রতীকী স্তুপ নির্মাণ করে কোনো না পীর বা পীরানীর নামে শিরনী, বাতাসা, দুধ ইত্যাদি নিবেদন করা হয়। তবে শ্যামপুরের যেসব স্থানে পীরের মাজার আছে, সেগুলি যে সংশ্লিষ্ট পীরের সমাধি তেমন নয়। এ বিষয়ে সীতাপুর দাওয়ান পীরের বর্তমান খাদেম (দরগার কর্তা বা পুরোহিত)রফিকুল ইসলাম জানান যে এই স্থাপত্য পীরের স্মরণে তৈরি একটি কল্পিত সমাধি যেখানে ভক্তরা এসে কোনো কিছু মানত করে বা অসুখ সেরে যাওয়ার কারণে পোড়া মাটির ঘোড়া উৎসর্গ করে বা শ্রদ্ধা জানায়।
তৃতীয়ত, বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে বা সময়ে পীরের কাছে যে জমায়েত হওয়া তার সঙ্গে বৌদ্ধ সংস্কৃতির মিল রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও স্তুপের সামনে এভাবেই মিলিত হন। বৌদ্ধ ধর্মে এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় 'মঙ্গলসূত্র মন্ত্রপাত'।
চতুর্থত, প্রাচীন বৌদ্ধদের থের-সমাধি- সংশ্লিষ্ট আচারগুলি, অর্থাৎ ধূপ-ধূনা জ্বালানো,চন্দন অনুলেপন,পুষ্পাঞ্জলি প্রদান ইত্যাদিও পীরধর্মে লক্ষ্য করা যায়।
এবার দাওন পীরের প্রসঙ্গে ফেরা যাক্। সীতাপুর ও কাশীপুর উভয় স্থানেরই জনশ্রুতি, দাওন সাহেব নামে সাতজন ভাই বাংলার বিভিন্ন এলাকায় ইসলামের প্রচার ও মানবসেবার জন্য এসেছিলেন। এই কাহিনি বোধহয় মিথ। অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন এলায়ায় পাঁচজন বা সাতজন ভাই পীর হিসেবে এসেছিলেন, এমন কথা প্রচলিত। নিকটবর্তী উদয়নারায়ণপুরের সিংটি গ্রামে ভাই খাঁ পীরের স্মরণে যে মেলা হয়, জনশ্রুতি অনুযায়ী তাঁরাও সাতভাই। তাঁরা প্রায় সাতশ বছর আগে সুদূর আরব থেকে এসে হাওড়া হুগলি, কলকাতায় আস্তানা বা 'খানকা' স্থাপন করেন।ভাই খাঁ ছাড়া অন্যান্যরা হলেন ফতে আলি খাঁ (মুন্সিরহাট,হাওড়া), মাদার আলি খাঁ (চাখানা, আমতা), জুম্মান খাঁ (পার্কসার্কাস, কলকাতা), সুফিক আলি খাঁ (বোড়হল,হুগলি), গোলাম আলি খাঁ (পারাম্বুয়া, হুগলি), মৌলালি খাঁ (শিয়ালদহ, কলকাতা)।
সুজন পীরঃ-
গড়চুমুক গ্রামে 'সুজন দীঘির' পাড়ে শাহ্ সুজন পীরের মাজার রয়েছে। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, সুজন পীর দামোদর নদের ধারে এই স্থানে বসবাস করতেন। শাজাহানের আমলে নূর নামের এক সামন্ত- রাজা পীরের অনুরোধে একটি মসজিদ ও সাধারণের জলকষ্ট নিবারণের জন্য একটি দীঘি খনন করিয়ে দেন। অলৌকিক ভাবে সুজন পীর এক রাতেই মক্কার আজমজমা থেকে দু' কুঁজো পবিত্র জল এনে একটি ঢেলে দেন দীঘিতে, অন্যটি রাখেন মসজিদে। যথাসময়ে রাজস্ব না দেওয়ায় বাদশাহ্ নূর খাঁকে হুকুম করেন "বাদশাহ্কা কড়ি নূর খাঁ কা নাম" বলার জন্য। কিন্তু নূর খাঁ ভুল করে "নূর খাঁ কা কড়ি বাদশাহ্কা নাম" বলায় বাদশাহর নির্দেশে তাঁর শিরশ্ছেদ করা হয়। সুজন পীর নূর খাঁর কাটা মুন্ড জোড়া লাগানোর জন্য মসজিদে রাখা মক্কার পবিত্র জলভরা কুঁজো নিয়ে সেদিকে অগ্রসর হলে বাদশাহর লোকজন তাঁকে বাধা দেয় ও উপহাস করতে থাকে। রুষ্ট পীর পথের পাশে বলিপ্রদত্ত একটি মোষের উপর কুঁজোর জল ঢেলে দিলে মোষটি জীবিত হয়ে ওঠে। কিন্তু সব জলটুকু খরচ করে ফেলায় নূর খাঁকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি। মসজিদটি বর্তমানে ভগ্ন ও জঙ্গলাকীর্ণ। এ কাহিনী যে সময়ের তখন মসজিদের পাশ দিয়ে প্রবল বেগে প্রবাহিত হত দামোদর। সম্ভবত তারই কোনো চোরা স্রোতে ভূমি বশে যাওয়ায় মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। মসজিদের উত্তরে রয়েছে প্রায় ২৫ বিঘার সুজন দীঘি এবং পূর্বে শাহ্ সুজন পীরের মাজার। ভগ্ন মসজিদে কয়েকটি পাথরের সুন্দর স্তম্ভ এবং ইটের তৈরী দেওয়ালের অংশ এখনো দৃশ্যমান । অতীতে নিকটবর্তী রায় পরিবারের পুকুর খননের সময় ইটের দেওয়াল ও ধূসর রঙের পাত্র পাওয়া গিয়েছিল। ইটগুলির মাপ ২০x১৯x ৫ সেমি.। হাওড়া জেলা গবেষক তারাপদ সাঁতরা এসবের প্রেক্ষিতে এ অঞ্চলে মুসলিম পূর্ব যুগে একটি প্রাচীন জনপদের অস্তিত্ব অনুমান করেছেন।

বড়খান গাজীঃ-
বারগ্রামের মসজিদের উত্তরে বড়খান বাবার থান রয়েছে। যদিও এটি তাঁর মাজার বা সমাধিক্ষেত্র নয়, 'খানকা' বা আস্তানা। বড় খান বাবা বা বড়খান গাজী ব্যাঘ্রদেবতা হিসেবে সর্বত্র খ্যাত। কথিত আছে,ইসলামের প্রচারের জন্য তিনি প্রথম যৌবনে পিতার বিপুল সম্পত্তি ত্যাগ করে সুন্দরবন অঞ্চলে চলে আসেন। সুন্দরবনে তাঁর প্রভাব সর্বাধিক হলেও হাওড়া, মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন গ্রামে তাঁর নামে থান রয়েছে। পূর্বে দামোদর তীরবর্তী বারগ্রাম সহ সমগ্র শ্যামপুর, বাগনান, উলুবেড়িয়া থানা গভীর অরণ্যসঙ্কুল ছিল। সম্ভবত নদীপথে যাতায়াতের সময় তিনি বারগ্রামের উক্ত স্থানে আস্তানা করেছিলেন।তিনি 'জিন্দা পীর' নামেও পরিচিত। মৈমনসিংহ-গীতিকার 'মহুয়া' পালায় বলা হয়েছে -
"চাইর কোন পিরথিমি গো
বইন্ধ্যা করলাম স্থির।
সুন্দরবন মোকামে বন্দলাম
গাজী জিন্দাপীর।। "
তবে গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু মনে করেন, 'বড় খান গাজী' বা 'জিন্দাপীর ' কারও ব্যক্তিনাম নয় ---- ইসলাম ধর্মপ্রচারকদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়দের ঐরূপ বলা হত।
************
তথ্য সূত্রঃ
১.বঙ্গে স্বূফী প্রভাব - মুহম্মদ এনামুল হক,২০১২
২. বাঙলার সূফী সাহিত্য - আহম্মদ শরীফ,২০১৫
৩. হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৭৬
৪. বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ - দুলাল চৌধুরী ( সম্পা.),২০০৪
৫. বাংলার লৌকিক দেবতা - গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু,১৯৬৬
৬. পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি - বিনয় ঘোষ, ১৯৯২
৭. হাওড়া জেলার মন্দির পূজা উৎসব মেলা- তপন কুমার সেন,২০০৯
৮. বুদ্ধ কেমন দেখতে ছিলেন - চিত্রা দেব,
৯. বাংলায় হিন্দু - মুসলমান সম্পর্ক ( মধ্যযুগ)- জগদীশ নারায়ণ সরকার,১৪২১
১০. মৈমনসিংহ গীতিকা - দীনেশচন্দ্র সেন( সম্পা),১৯৫৮
১১. Hindu- Muslim Relation in Mughal Bengal - Shah Noor Rahman, 2001
১২. 'চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম' পত্রিকা, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২০
১৩. 'খোলামন ' পত্রিকা, ১৯ ডিসেম্বর ২০২০

Tuesday, December 29, 2020

সপ্তম পর্বঃ পিছলদহ (Pichhaldaha)

হাওড়া জেলার দক্ষিণে শ্যামপুর থানার অন্তর্গত পিছলদহ গ্রামের (২২.২৫° উত্তর ,৮৮.০৩° পূর্ব)) নামকরণ সম্পর্কে স্থানীয় একটি জনশ্রুতি হল মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য পুরী থেকে পাণিহাটি যাওয়ার পথে এই স্থানে আড়াই দন্ড কাল(১ঘন্টা) বিশ্রাম নিয়েছিলেন এবং এখান দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর পা পিছলে যায়। সেই থেকেই এই গ্রামের নাম পিছলদহ। 'দহ' শব্দটি সংস্কৃত হ্রদ থেকে এসেছে যার অর্থ বিরাট জলাশয়।অর্থাৎ নদীতীরবর্তী এই ভূভাগের তীরভূমিতে পা পিছলে যাওয়া থেকেই ' পিছলদহ' নাম। এই ব্যাখ্যা কতটা গ্রহণযোগ্য তা ক্রমশঃ প্রকাশ্য। আগে দেখে নেওয়া যাক্ প্রাচীন মানচিত্রে এই স্থানটির কোনো উল্লেখ আছে কিনা।
দেখা যাচ্ছে, ১৫৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ডি- ব্যারোজ ও ১৫৬১ খ্রীস্টাব্দের গাস্টালডির মানচিত্রে বঙ্গোপসাগরের কাছে রূপনারায়ণ (?) ও দামোদরের(?) মধ্যবর্তী একটি স্থানকে যথাক্রমে 'পিসলতা'(Pisolta) এবং ' পিকলদা'(Picalda) নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। ও. ম্যালি ১৮৯২ সালে প্রকাশিত সি. আর. উইলসনের জার্নালের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে জানিয়েছেন -"Pisolta has been identified with the modern village of Pichhaldaha, close to Fort Mornington Point." এই 'ফোর্ট মর্নিংটন পয়েন্ট' হল ১৭৬৫-১৭৬৭ খ্রীষ্টাব্দে লর্ড ক্লাইভের দ্বারা নির্মিত একটি দুর্গ (বর্তমানে ভগ্নদশা) যা গাদিয়াড়া (হাওড়া) রূপনারায়ণ টুরিস্ট লজের সামনে নদীর পাড় থেকে ২৫ মিটার পূর্বে অবস্থান করছে। ও. ম্যালির বর্ণনা থেকে বর্তমান পিছলদহ গ্রামের পূর্ব নাম যে 'পিসলতা' বা ' পিকলদা' ছিল সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার আগে পাঠককে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগী হতে অনুরোধ করছি।সেটা হল চৈতন্য প্রসঙ্গ।


অন্যতম চৈতন্যজীবনীকার কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী আনুমানিক ১৬১৬ খ্রীস্টাব্দে রচিত শ্রীশ্রী চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের মধ্যলীলার ষোড়শ পরিচ্ছেদে 'পিচ্ছলদা' শব্দটি দু'বার ব্যবহার করেছেন। 'পিচ্ছলদা' শব্দটি 'পিছলদহ' শব্দের অপভ্রংশ হতে পারে। গ্রন্থে বলা হয়েছে --
১. পিচ্ছলদা পর্যন্ত সব তার অধিকার।
তার ভয়ে নদী কেহ হৈতে নারে পার।।
২. মন্ত্রেশ্বর দুষ্ট নদে পার করাইল।
পিচ্ছলদা পর্যন্ত সেই যবন আইল।।
চৈতন্যজীবন পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৫১৪ খ্রীষ্টাব্দের বিজয়াদশমীর দিন শ্রীচৈতন্য 'গৌড় দেশ দিয়া' বৃন্দাবনের উদ্দেশে যাওয়ার জন্য উড়িষ্যার পুরী থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। সেসময় বঙ্গদেশ থেকে পুরী যাতায়াতের যে তিনটি পথের উল্লেখ পাওয়া যায় সেগুলি হল --
ক) দক্ষিণ বঙ্গের যাত্রীদের জন্য -
আটিসারা ( বারুইপুর) > ছত্রভোগ > (জয়নগর -মজিলপুর) > তমলুক > নারায়ণগড় > দাঁতন > জলেশ্বর > ভদ্রক > পুরী
খ) মধ্যবঙ্গের যাত্রীদের জন্য -
পাণিহাটি > আন্দুল > সাঁকরাইল > নিমকির খাল ধরে বাগনান > কোলাঘাট > পাঁশকুড়া > রঘুনাথবাড়ি > পিছলদা > নারায়ণগড় > বেলদা > দাঁতন > সুবর্ণরেখা ধরে জলেশ্বর > রেমুণা >যাজপুর > কটক > ভুবনেশ্বর > পুরী
গ) উত্তর বঙ্গের যাত্রীদের জন্য -
বর্ধমান > হাজিপুর > মেদিনীপুর > হরিহরপুর > কেশপুর > নারায়নগড় > বালেশ্বর > নীলগড় > বৈতরণী >সাক্ষীগোপাল > পুরী
এই তিনটি পথের কোনোটি ছিল পায়ে হাঁটা, কোনোটি আবার নদীর আধিক্য থাকার কারণে ব্যয়বহুল। এজন্য সেসময় বঙ্গদেশে একটা প্রবাদ প্রচলিত ছিল --
"হাতে কড়ি পায়ে বল
তবে যাবি নীলাচল।"
এখন প্রশ্ন, চৈতন্য সেবার পুরী থেকে পাণিহাটি গিয়েছিলেন কোন্ পথে?
চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে দ্বিতীয় পথটির কিছু কিছু স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ পথেই পিছলদার (পিছলদহ) অবস্থান। কবিরাজ গোস্বামী জানিয়েছেন, মন্ত্রেশ্বর নদের একদিকে ওড্রদেশ( উড়িষ্যা) তথা প্রতাপরুদ্রের (১৪৯৭-১৫৪০ খ্রীষ্টাব্দ) সীমা, আর একদিকে 'পিচ্ছলদা' অর্থাৎ যবনরাজ্য শুরু (বাংলা) যার সর্বময় কর্তা আলাউদ্দীন হুসেনশাহ( ১৪৯৩-১৫১৯ খ্রী.)।
চৈতন্যের গৌড় যাত্রাকালে বাংলার সঙ্গে উড়িষ্যার সম্পর্ক মধুর ছিল না। যোগেশচন্দ্র বসু লিখেছেন -" শ্রীচৈতন্য যে সময় উড়িষ্যায় গমন করেন,সে সময় উৎকলের হিন্দু রাজার সহিত বাঙ্গালার মুসলমান সুলতানের বিবাদ চলিতেছিল।" ১৫০৯ খ্রীস্টাব্দের শেষ দিকে হুসেন শাহের সেনাপতি ইসমাইল গাজী উড়িষ্যা আক্রমণ করে কিছু অঞ্চল দখল করে নেন কিন্তু প্রতাপরুদ্র শেষপর্যন্ত অধিগৃহীত এলাকা পুনরুদ্ধার করে বঙ্গের হুগলী নদী (গড় মান্দারণ) পর্যন্ত সীমানা বিস্তার করেছিলেন। তবে প্রধান কর্মচারী গোবিন্দ বিদ্যাধরের ষড়যন্ত্র ও হুসেন শাহের বারবার আক্রমণের ফলে প্রতাপরুদ্রের শাসনের পূর্ব সীমা কিছুটা সংকুচিত হয়ে পড়ে।
১৫১৪ খ্রীস্টাব্দে এই পরিস্থিতি ছিল ভয়ানক।সেই কারণে রাজা প্রতাপরুদ্র ও রায় রামানন্দ (রাজা প্রতাপরুদ্রের অধীনস্থ গোদাবরী তীরবর্তী বিদ্যানগরের শাসনকর্তা) চৈতন্যের গৌড় যাত্রা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলেন।পূর্বেই বলা হয়েছে পুরী থেকে গৌড়ে যাবার পথ ছিল তিনটি। শিশির কুমার ঘোষ জানিয়েছেন," সেইসময় এমন যুদ্ধ বাঁধিয়া উঠিয়াছে যে, এই তিন পথই বন্ধ।" জীবনীকারদের বিবরণ অনুযায়ী চৈতন্য অনেক লোকজন নিয়ে পুরী থেকে যাত্রা করে ভুবনেশ্বর, কটক, যাজপুর, রেমুনা হয়ে উড়িষ্যা সীমানা মন্ত্রেশ্বর উপকূলে উপস্থিত হন। বিতর্কের শুরু এই মন্ত্রেশ্বর নদের তীরের একটি ভূখন্ডকে ঘিরে। সমনামে হাওড়া (পিছলদহ) ও পূর্ব মেদিনীপুর (পিছলদা) জেলায় দুটি স্থান রয়েছে এবং দুটি স্থানেই মহাপ্রভুর বিগ্রহ ও মন্দির বিদ্যমান।



অনেকে মনে করেন, এই উড়িষ্যা সীমানা বলতে তমলুক বা তার নিকটবর্তী কোনো অঞ্চলকে বোঝানো হয়েছে এবং মন্ত্রেশ্বর নদ বর্তমান রূপনারায়ণের পূর্ব নাম। পিচ্ছলদা হল বর্তমান হাওড়া জেলার দক্ষিণে শ্যামপুর থানার অন্তর্গত পিছলদহ গ্রাম। কবিরাজ গোস্বামীর বিবরণের প্রেক্ষিতে তাঁদের যুক্তি, পুরী থেকে উড়িষ্যা সীমায় অর্থাৎ তমলুকে পৌঁছানোর পর সেখানকার 'রাজ-অধিকারী' (ভূমিরক্ষক বা প্রশাসক) শ্রীচৈতন্যকে 'দিন দুই চারি ' সেখানে বিশ্রাম নেবার পরামর্শ দেন যাতে তিনি নদীর ওপারের অর্থাৎ বাংলার সীমার (পিছলদহ) 'মদ্যপ যবন' প্রশাসকের সঙ্গে 'সন্ধি' করে নিরাপদে নদী পেরিয়ে মহাপ্রভুর ' সুখেতে' পাণিহাটি যাত্রার ব্যবস্থা করতে পারেন। এদিকে 'জগন্নাথ হৈতে 'আগত' এক সন্ন্যাসী'র আগমণের খবর পেয়ে সেই যবন প্রশাসক তাঁর এক চরকে হিন্দুর ছদ্মবেশে উড়িষ্যা সীমান্তে সবিস্তারে খবর নিতে পাঠান এবং সেই চর ফিরে গিয়ে তাঁকে সকল বৃত্তান্ত জানান। তিনি সেই বর্ণনা শুনে ভাববিগলিত হয়ে পড়েন এবং নিজে উড়িষ্যা সীমানায় পৌঁছে চৈতন্যের শ্রী চরণে প্রণাম জানিয়ে পরম ভক্তে রূপান্তরিত হন। তিনিই মহাপ্রভুর নির্বিঘ্নে বাংলায় যাত্রার সুবন্দোবস্ত করে দেন। জলদস্যুর হানা প্রতিরোধের নিমিত্তে দশ নৌকা ভর্তি সৈন্য নিয়ে চৈতন্য ও তাঁর লোকজনদের একটি 'নবীন নৌকা'য় ( সুরম্য) চাপিয়ে তমলুক থেকে মন্ত্রেশ্বর পার হয়ে পিছলদহে নিয়ে আসেন। তারপর সেই যবন নিজ স্থানে অর্থাৎ পিছলদহে থেকে যান এবং আড়াই দন্ড বিশ্রাম নিয়ে মহাপ্রভু হুগলি নদী পথে বেতড় , কলকাতা, শুকচর অতিক্রম করে সপার্ষদ পাণিহাটিতে পৌঁছান।শ্যামপুর থানার পিছলদহে প্রাচীন বট, অশ্বত্থ ও তমাল বৃক্ষ সংলগ্ন এলাকাকে স্থানীয় মানুষজন চৈতন্য পাদস্পর্শিত পবিত্র ভূমি বলে মনে করেন।
এবার সমকালীন ইতিহাসের আলোকে উপরোক্ত দৃষ্টিকোণ পর্যালোচনা করে দেখা যাক্।
বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী মন্ত্রেশ্বর নদের উল্লেখ শুধু চৈতন্যচরিতামৃত নয়, জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল, কবি কর্ণপুরের চৈতন্যচন্দ্রোদয়, গোবিন্দদাসের কড়চা, কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল সহ অষ্টাদশ শতকের একাধিক বৈষ্ণব শ্রীপাট বিবরণীতে পাওয়া যায়। যদিও ষোড়শ শতকের কোনো মানচিত্রে (ডি-ব্যারোজ ১৫৫৩, গাস্টালডি -১৫৬১,হন্ডিভ্স-১৬১৪, ক্যান্টেলি দ্য ভিগনোলা-১৬৮৩, ভ্যান ডেন ব্রুক-১৬৬০, জি. ডেলিসলে-১৭২০, ইজাক টিরিঅন-১৭৩০, এফ. ডে উইট-১৭২৬, রেনেল-১৭৬৪) এই নামের কোনো নদীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না । এবার রূপনারায়ণের প্রসঙ্গে আসা যাক্। বিভিন্ন সময়ের মানচিত্রকর ভিন্ন ভিন্ন নামে রূপনারায়ণকে চিহ্নিত করেছেন, যেমন গঙ্গা (ডি-ব্যারোজ এবং গাস্টালডি), গুয়েঙ্গা ( ব্লেভ), তাম্বোলি(টমাস বাউরি), তোম্বারলি(পাইলট চার্ট), পাত্র ঘাটা(ভ্যালেনটিন), রেনেল( রূপনারায়ণ)। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কেউই 'মন্ত্রেশ্বর' শব্দটি ব্যাবহার করেন নি। এর কারণ হতে পারে মন্ত্রেশ্বর তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো নদ নয় বা দৈর্ঘ্য প্রস্থের বিচারে তার প্রবাহ এত নগণ্য যে আলাদা করে উল্লেখ করার দাবি রাখে না।


জলদস্যুর প্রসঙ্গটি ইতিহাসসম্মত। 'মেদিনীপুরের ইতিহাস' গ্রন্থে বলা হয়েছে - "....নদী পার হওয়া বড়ই দুঃসাধ্য ছিল। ... জলপথ জলদস্যুসমাকুল ছিল।" চৈতন্যচরিতামৃতে এজন্য 'মন্ত্রেশ্বর দুষ্ট নদ' বলা হয়েছে। তবে শুধু মন্ত্রেশ্বর নয় সেসময়ের অনেক নদ নদীতেই জলদস্যুরা হঠাৎ হঠাৎ আক্রমণ করে লুঠপাট চালাত। এমনকি বঙ্গোপসাগর থেকে সংকীর্ণ নদীপথে অনেকটা ভিতরে গিয়েও আক্রমণ, হত্যা ও লুন্ঠন চালাত বলে বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ আছে।
উপরোক্ত মতাবলম্বীরা উড়িষ্যার সীমা হিসেবে যে তমলুকের কথা বলেছেন তা যথাযথ বলে মনে হয় না। কারণ পুরী মন্দিরে সংরক্ষিত তালপাতায় হস্তলিখিত মাদলাপঞ্জীর বিবরণ অনুযায়ী সেসময় উড়িষ্যা বা উৎকলদেশ যে ৩১ টি দন্ডপাঠে বিভক্ত ছিল তার মধ্যে ৬ টি দন্ডপাঠ বর্তমান মেদিনীপুর জেলার (অখন্ড) অন্তর্ভুক্ত। যথা- (১) টানিয়া, (২) জৌলিতি, (৩) নারায়ণপুর, (৪) নইগাঁ, (৫) মালঝিটা, (৬) ভঞ্জভূম-বারিপাদা। এই দন্ডপাঠগুলি যেসব এলাকা বা অঞ্চলকে নির্দিষ্ট করত তাদের মধ্যে তমলুকের উল্লেখ নেই। যোগেশচন্দ্র বসু লিখেছেন - "তৎকালে তাম্রলিপ্ত একটি স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল; উহা উড়িষ্যার অন্তর্গত ছিল না। তাম্রলিপ্তের দক্ষিণ হইতেই উড়িষ্যার সীমা আরম্ভ হইয়াছিল।" চৈতন্যচরিতামৃতে 'ওড্রদেশসীমা'য় যে রাজ অধিকারীর কথা বলা হয়েছে তিনি উৎকলরাজ প্রতাপরুদ্রের অধীন একজন প্রশাসক।

তাহলে স্থানটি তমলুক নয়।কেননা চৈতন্য মাত্র একবারই তমলুকে পদার্পণ করেছিলেন বলে ( ১৫১০ খ্রীস্টাব্দে প্রথমবার ছত্রভোগ হয়ে পুরী যাত্রার সময়) জীবনীকাররা উল্লেখ করেছেন। তমাল বৃক্ষের নিচে আড়াই দন্ড বিশ্রাম নেওয়ার প্রসঙ্গটি কোনো জীবনী গ্রন্থে নেই।
এবার আসা যাক্ 'ওড্রদেশ সীমা'য় সেই রাজ অধিকারীর প্রসঙ্গে। তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় 'শ্রীচৈতন্যের পুরী যাত্রাপথ' শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন যে সেই অধিকারী হলেন গোপীনাথ পট্টনায়ক । আনুমানিক ১৫৭২ খ্রীস্টাব্দে রচিত কবি কর্ণপুরের সংস্কৃত নাটক 'চৈতন্যচন্দ্রোদয়' ও অন্যান্য চৈতন্যজীবনী অনুসরণে শিশির কুমার ঘোষ যে 'অমিয় নিমাইচরিত' গ্রন্থ রচনা করেছেন তাতে বলা হয়েছে, পিচ্ছলদার যবন সীমারক্ষক যখন চৈতন্য ভক্তে রূপান্তরিত হলেন ''তখন গোপীনাথ বলিতেছেন, 'ওহে অধিকারি, প্রভূ গণসহ গৌড়ে যাইবেন, তুমি তাঁহার সহায়তা কর।"এই গোপীনাথ পট্টনায়ক কে? যোগেশচন্দ্র বসু তাঁর 'মেদিনীপুরের ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন-" ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম পাদে চৈতন্যদেবের প্রিয়শিষ্য রামানন্দ রায়ের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গোপীনাথ পট্টনায়ক মালঝিটা দন্ডপাঠে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।" বর্তমানের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি, রামনগর, খেজুরী ও ভগবানপুর থানাধীন এলাকা নিয়ে গঠিত ছিল সেকালের মালঝিটা দন্ডপাঠ। অর্থাৎ এই মালঝিটা দন্ডপাঠ অধীন এলাকার প্রান্ত দিয়ে বয়ে যেত মন্ত্রেশ্বর। এই অঞ্চলের ক্ষেত্রসমীক্ষা করে তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় আরও জানিয়েছেন - "প্রাচীন পথ দেখে মনে হয় কংসাবতী থেকে মন্ত্রেশ্বর উৎপন্ন হয়ে পিছলদার (পূর্ব মেদিনীপুর) পশ্চিমপ্রান্ত দিয়ে কিছুটা অগ্রসর হয়ে (বর্তমানে রসুলপুর নদী) সমুদ্রে প্রবেশ করত। "ড. এস. কে. অয়নগর তাঁর 'Cambridge History of India' গ্রন্থেও মন্ত্রেশ্বর নদের এমন অবস্থান অনুমান করেছেন। মনে হয় মন্ত্রেশ্বর নদী কংসাবতী থেকে উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণে অগ্রসর হয়েছিল সমুদ্রের দিকে। এ অনুমান অমুলক নয়। কারণ মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কবি রামচন্দ্রের লেখা একটি প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথি আবিষ্কার করেছিলেন। তাতে তাম্রলিপ্তের রাজা গোপীচন্দ্রের নাম পাওয়া যায়। সেই পুঁথিতে উল্লিখিত গোপীচন্দ্রের কাহিনী যোগেশচন্দ্র বসুর ভাষায় - "গোপীচন্দ্র ছত্রেশ্বরী দেবীর সম্মুখে ক্রোধে অধীর হইয়া এক ব্রাহ্মণের শিরশ্ছেদ করায় দেবী অধোমুখী হইয়া থাকেন। কিছুদিন পরে গোপীচন্দ্র পাঙ্গাভূমিতে গিয়া গঙ্গাসাগরের স্রোতে মন্ত্রেশ্বরের কাছে জলে ডুবিয়া যান।" এই বর্ণনা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় মন্ত্রেশ্বরের ধারা সাগরদ্বীপের নিকটবর্তী জলপ্রবাহে গিয়ে মিশত। সেদিক থেকে রূপনারায়ণের সঙ্গে তার দূরত্ব অনেক।
সেকালে সম্ভবত পিছলদার পাশ দিয়ে একটি ধারা রঘুনাথবাড়ি হয়ে পাঁশকুড়া পর্যন্ত ছিল যে পথে চৈতন্য পাঁশকুড়ায় পৌঁছেছিলেন।ষোড়শ শতকের প্রথমদিকে এই নদ প্রসস্থ ছিল না বলেই মনে হয়। কারণ সমকালের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে লিখেছেন - "বুড়া মন্ত্রেশ্বর বায় বানিয়ার বালা"। রামকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর গবেষণামূলক 'ধনপতির সিংহলযাত্রা' উপন্যাসের 'নদ-নদীর মগরা গমন' (২৭) শীর্ষক পরিচ্ছেদে সহমত পোষণ করে মন্ত্রেশ্বর ও রূপনারায়ণকে পৃথক দুটি নদী হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
পিছলদার পার্শ্ববর্তী ডিহি কাশিমপুরে প্রাচীন একটি গৌরমূর্তি আছে যার কথা নবদ্বীপবাসী হরিদাস দাস তাঁর 'মধ্যযুগীয় গৌড়ীয় সাহিত্যের ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক অভিধান' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। রঘুনাথবাড়ি ও পাঁশকুঁড়ার মন্দিরে মহাপ্রভুর প্রাচীন বিগ্রহ চৈতন্যের যাত্রাপথের স্মৃতি নিয়ে আজও বিরাজমান।
এবার আসা যাক পাণিহাটি পর্যন্ত বাকি পথপরিক্রমা প্রসঙ্গে ।জগদীশ চক্রবর্তী তাঁর 'তাম্রলিপ্ত তমলুক থেকে দূরে' প্রবন্ধে ভাগীরথীর বেতড়- উলুবেড়িয়া - পাঁশকুড়া - পিংলা ও নারায়ণগড় গামী লুপ্ত খাতের কথা বলেছেন। বিপ্রদাস পিপলাই-এর মনসামঙ্গল ও কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে বর্ণিত গঙ্গার গতিধারার সঙ্গে এই ধারণার মিল রয়েছে । মুকুন্দরাম চণ্ডীমঙ্গলে লিখেছেন, শ্রীমন্ত সদাগরের নৌকা কলকাতা ও বেতড় পার হয়ে কালিকট যাবার সময় "ডাহিনে ছাড়িয়া যায় হিজলির পথ।" আবার হরিদাস দাস তাঁর 'বৈষ্ণব তীর্থ' গ্রন্থে এই জলপথের কথা সমর্থন করে জানিয়েছেন যে চৈতন্যদেবের সময়ে বেতড়ের একটু দক্ষিণ থেকে গঙ্গা বা ভাগীরথীর একটি শাখা পশ্চিমবাহিনী হয়ে আন্দুলের ওপর দিয়ে উলুবেড়িয়া, বাগনান হয়ে প্রবাহিত হত। 'বদর শাহের চড়' নামে অধিক পরিচিত এই পথ দিয়ে পর্তুগীজ নাবিকরা লবনের ব্যবসা করত। যদিও এই জলপথের স্থানীয় নাম ছিল 'নিমকির খাল '। পরবর্তীকালে কেউ কেউ একে 'কাটি গঙ্গা'ও বলেছেন। তাঁদের ধারণা গঙ্গাকে সরল পথে চালনার জন্য ইংরেজরা এই পথটি কেটেছিলেন। কিন্তু তা একেবারেই সত্যি নয়। এটি ভাগীরথীর প্রাচীন খাত। চৈতন্যপার্ষদ নিত্যানন্দ যে এই পথেই সাঁকরাইল থেকে আন্দুলে কৃষ্ণানন্দ চৌধুরীর অতিথি হয়েছিলেন তা জীবনীগ্রন্থ থেকে জানা যায়। যোগেশচন্দ্র বসু লিখেছেন - "এই পথ দিয়া অতি অল্প দিনেই উড়িষ্যায় যাওয়া যাইত।" শ্রীচৈতন্য যে একদিনেই পিছলদা থেকে পাণিহাটিতে রাঘব পন্ডিতের বাড়ি পৌঁছেছিলেন সেকথা জীবনীগ্রন্থে উল্লেখ করা আছে।
বিনয় ঘোষ রচিত ' পশ্চিম বঙ্গের সংস্কৃতি' গ্রন্থের সৌজন্যে প্রাপ্ত ষোড়শ -সপ্তদশ শতকের একটি মানচিত্রে পিছলদহ স্থানটিকে তমলুকের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের নিকটে চিহ্নিত করা হয়েছে যা স্পষ্টতই পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত । হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর একটি অভিভাষণে জানিয়েছেন "খ্রীষ্টের জন্মের চৌদ্দ শত কি পনর শত বৎসর পরে যেসকল মনসার ও চন্ডীর গান পাওয়া যায়, তাহাতে তমলুকের নাম নাই। সেসময় লোকে পিছলদা ও ছত্রভোগ হইয়া সমুদ্রে যাইত।" এই ছত্রভোগ বর্তমান জয়নগর- মজিলপুর (দক্ষিন ২৪ পরগণা) থেকে ৬ কিমি. দক্ষিণে অবস্থিত ছিল।

ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বিচার করলে শ্যামপুর অঞ্চলটি খুব প্রাচীন বলে মনে হয় না। নিকটবর্তী এলাকায় যে সব স্থাপত্যের সন্ধান পাওয়া গেছে তা অষ্টাদশ বা তার পরবর্তী কালের।সমগ্র অঞ্চলটি যে একদা নদীগর্ভে ছিল তার প্রমান বিভিন্ন সময়ে খননে প্রাপ্ত নৌকার খোল বা মাস্তুলের অংশবিশেষ থেকে পাওয়া যায়। পরে চর হিসেবে জেগে ওঠে ও অরণ্যসমাকীর্ণ হয়ে পড়ে।প্রবীণ ব্যক্তিদের বক্তব্যেও তা স্পষ্ট। তারপর মূলতঃ মেদিনীপুর থেকে বাসিন্দারা এই জেগে ওঠা চরভূমিতে এসে জঙ্গল পরিষ্কার করে বসবাস শুরু করে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে জনপদ। এজন্য এ অঞ্চলের অনেক গ্রামের নামের সঙ্গে মেদিনীপুরের গ্রামনামের মিল পাওয়া যায়। যেমন- ভগবানপুর, কমলপুর, বরদাবাড়, শ্যামপুর, রাধাপুর, কামদেবপুর, চাউলখোলা ইত্যাদি।
সেদিক থেকে বিচার করলে পূর্ব মেদিনীপুর জেলাধীন পিছলদা সহ সমগ্র ভগবানপুর থানা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা যথেষ্ট প্রাচীন। স্থানীয় স্থাপত্য ও বনেদী পরিবারের কুলপরিচয়ের পরম্পরা বিচার করলেও তার প্রমান মেলে।
তথ্য, ঐতিহাসিক প্রমাণ ও যুক্তির পারম্পর্য নিরপেক্ষ ভাবে পর্যালোচনার পরেও পিছলদহে শ্রীচেতন্য প্রসঙ্গটির সিদ্ধান্ত টানা সম্ভব নয়।কারন সেকাল- একালের পারস্পরিক আলোচনায় এখনও কিছু প্রশ্ন অমীমাংশিত থেকে গেল। সেগুলি এবার দেখে নেওয়া যাক্----
ক) তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় যে উড়িষ্যার সীমারক্ষকের কথা বলেছেন তিনি মালঝিটা দন্ডপাঠের গোপীনাথ পট্টনায়ক নাও হতে পারেন।চৈতন্যচরিতামৃতে তাঁর নামের উল্লেখ নেই। আবার শিশির কুমার ঘোষ গোপীনাথের যে উক্তি তুলে ধরেছেন, কবিরাজ গোস্বামীর কাব্যে সেই উক্তির বক্তা মুকুন্দ দত্ত। জীবনীকার লিখেছেন-
তবে মুকুন্দ দত্ত কহে শুন মহাশয়।
গঙ্গাতীরে যাইতে মহাপ্রভুর মন হয়।।
তাহা যাইতে কর তুমি সহায় প্রকার।
এই বড় আজ্ঞা এই বড় উপকার।।

আবার, চৈতন্যের সঙ্গী হিসেবে যাঁরা সেদিন পুরী থেকে গৌড়ে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন মহাপ্রভুর একান্ত ভক্ত গোপীনাথ আচার্যও। তাই প্রশ্ন থাকবেই উক্তিটির বক্তা সেই গোপীনাথ আচার্য নন তো?
খ) মাদলা পঞ্জীর বিবরণ অনুযায়ী, তাম্রলিপ্ত স্বশাসিত ছিল,উড়িষ্যা রাজ্যের দন্ডপাঠগুলির অন্তর্ভুক্ত ছিল না। আসলে অনঙ্গভীমদেবের সময় থেকে মুকুন্দদেবের রাজত্বকাল পর্যন্ত (১১৭৫-১৫৬৯ খ্রী.) উড়িষ্যার গঙ্গ বংশীয় রাজারা তমলুকের তদানীন্তন রাজবংশকে উৎখাত না করে তাঁদের সামন্ত রূপে রাজত্ব করার সুযোগ দেন। সেদিক থেকে বিচার করলে তমলুকও উড়িষ্যা রাজ্যেরই সীমা, নয় কি?
গ) শ্যামপুর থানার পিছলদহ গ্রামের মহাপ্রভু আশ্রমের উত্তরদিকে তমাল বৃক্ষ থেকে প্রায় ১৫ ফুট দূরে দেড় ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট একটি টেরাকোটার (পোড়ামাটির) মুন্ড রাঢ় অঞ্চলের লৌকিক দেবতা দক্ষিণ রায় হিসেবে খোলা জায়গায় পুজিত হন। অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষে এই দেবতার বার্ষিক উৎসব হয়। দক্ষিণরায় অরণ্য ও বাঘের দেবতা।স্থানটি যে একদা অরণ্যসমাকীর্ণ ও ব্যাঘ্রসংকুল ছিল তা এ থেকেই বোঝা যায়। একসময় মাটি খনন করতে গিয়ে এটি পাওয়া গেছে বলে প্রবীনদের মত। আবার এই গ্রামেরই মুখোপাধ্যায় পরিবারে সম্ভবত মস্তকবিহীন প্রাচীন এক নৃসিংহমূর্তি বারাহীচন্ডী হিসেবে পূজিত হন। সেটিও পুকুর খননের সময় উদ্ভুত। ভাস্কর্যশৈলীর নিরিখে এটি দ্বাদশ শতাব্দীর পাল যুগের বলে অনুমান।প্রাচীন মূর্তির পিছনে বর্তমানে সিংহবাহনে আসীন চতুর্ভূজা বর্ণময় সুসজ্জিত চন্ডীমূর্তি নির্মাণ করা হয়েছে। দেবীর ডানদিকে কৃষ্ণ বর্ণের প্রায় ৩ ফুট দৈর্ঘ্য,১ ফুট প্রস্থ ও দেড় ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট আয়তাকার একটি প্রস্তরখন্ড রয়েছে। মনে হয় এটি কোনো স্থাপত্যের অংশ। তাছাড়া গ্রামে বিভিন্ন সময় পুকুর, কুয়া ইত্যাদি খনন করতে গিয়ে পুরানো খোলামকুচি, মৃৎপাত্র, মটির তৈজস ইত্যাদি পাওয়া গিয়েছে একাধিকবার। হাওড়া জেলা গবেষক তারাপদ সাঁতরা বলেছেন - "এখানে উৎখনন চালালে আরও প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের সম্ভাবনা আছে।" তাই প্রশ্ন হল এই টেরাকোটার মুখ, প্রস্তর মূর্তি বা স্থাপত্যের অংশ কি এ অঞ্চলে প্রাচীন কোনো জনপদের ইঙ্গিত বহন করছে?





রূপনারায়ণের প্রাচীন গতিপথ ও আজকের গতিপথের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে যথেষ্ট। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়,দ্বারকেশ্বর ও শিলাবতীর মিলিত প্রবাহে সৃষ্ট এই নদ একসময় বাগনান - খালোড় - বাঁটুল - মুগকল্যান - হরিনারায়ণপুর - হাল্যান - কাঁটাগাছি - প্রতাপপুর - আমড়দহ- দানপেতিয়া - বাছরি- বৈঁচি - নারায়ণপুর- - কোটরা - কালীদহ - পিছলদহ - ইত্যাদি এলাকার উপর দিয়ে প্রবাহিত হত। বর্তমানে তা প্রায় ছয়- সাত কি.মি. পশ্চিম দিকে সরে গেছে। এইকারণে ঐসব এলাকা থেকে আকশ্মিকভাবে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রত্নবস্তু খুঁজে পাওয়া গেছে। যেমন- সামতাবেড়িয়া (বিষ্ণু-বাসুদেব মূর্তি), খালোড়( বিষ্ণুমূর্তি), বাগনান-হরিনারায়ণপুর(বাসুদেবমূর্তি, মহিষমর্দিনী মূর্তি), বাছরি(বিষ্ণুমূর্তি, বিষ্ণুপট্ট), শ্যামপুর হরিনারায়ণপুর (বৌদ্ধ তারা মূর্তি), আমবেড়ে(দক্ষিণ রায়ের শিলা পিতলের কৌটায় যা বৌদ্ধ চৈতের ক্ষুদ্র সংস্করণ), দেউলি( বিষ্ণুমূর্তি), নুনেবাড়(বিষ্ণুমূর্তি), রাধাপুর(রোমান রণদেবতা জানুস-এর মূর্তি), পিছলদহ( নৃসিংহমূর্তি ও টেরাকোটার মুন্ড)। হিউএন সাং- এর বিবরণ অনুযায়ী, প্রাচীন তাম্রলিপ্ত রাজ্যটির আয়তন ছিল ১৪০০-১৫০০ লি। কানিংহামের মতে ৬ লিতে ১ মাইল হয়। অর্থাৎ প্রায় ৪০০ কি. মি. বিস্তৃত ছিল সেই বাণিজ্য নগরী। প্রাজ্ঞ ক্ষেত্রসমীক্ষক শিবেন্দু মান্নার মতে "সুপ্রাচীন তাম্রলিপ্ত সভ্যতা ও সংস্কৃতি বলয়ের মধ্যে বর্তমান কালের শ্যামপুর ও বাগনান এলাকার অন্তর্ভুক্তি সুনিশ্চিত।"
নদী কিংবা ইতিহাস এখনও নিরুত্তর। বিস্রস্ত চিহ্নের সূত্র এখনও অনায়ত্ত। চৈতন্য জন্মভূমির মতো চৈতন্য পাদস্পর্শে পুণ্যভূমি পিছলদহ এখনও অধরা। কিংবদন্তী আর ইতিহাসের সমন্বয়ে কবে মিলবে সেই খোঁজ, জানা নেই। তাই সুদূর অতীতের সেই ধূসর পান্ডুলিপির হরফ উদ্ধারে অনুসন্ধান চলতে থাকবে।
***********
তথ্য সূত্রঃ-
১. চৈতন্যচরিতামৃত - কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী ( সম্পা.-উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়), ১৯৮৬
২. চৈতন্য ভাগবত- বৃন্দাবন দাস( সম্পা.- কাঞ্চন বসু),১৯৮৩
৩.চণ্ডীমঙ্গল - কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ( সম্পা.- সুকুমার সেন),২০০৭
৪. বাইশা- (সম্পা.- আশুতোষ ভট্টাচার্য), ১৯৫৪
৫. শ্রী গৌড়ীয় পত্রিকা - ৭ বর্ষ,৪২ সংখ্যা,১৯২৯
৬. শ্রী শ্রী গৌড়ীয় বৈষ্ণব তীর্থ - হরিদাস দাস
৭. অমিয় নিমাই চরিত - শিশির কুমার ঘোষ,১৯৮৯
৮. মেদিনীপুরের ইতিহাস - যোগেশচন্দ্র বসু, ১৯৭৮
৯. বাঙালীর ইতিহাস (আদি পর্ব)- নীহাররঞ্জন রায়,১৯৮০
১০. হাওড়া শহরের ইতিবৃত্ত ( ১ম খন্ড) - অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়,১৯৯৪
১১. গঙ্গা পথের ইতিকথা - অশোক কুমার বসু, ১৯৮৯
১২. বাংলার হারানো নদীর ইতিকথা - প্রীতিতোষ রায়, ২০১২
১৩. বাংলাদেশের নদ-নদী ও পরিকল্পনা - কপিল ভট্টাচার্য, ১৯৫৪
১৪. পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি - বিনয় ঘোষ, ১৯৯২
১৫. তমলুকের ইতিহাস - প্রদ্যোৎ কুমার মাইতি,২০১৫
১৬. হাওড়া ইতিহাস ও ঐতিহ্য - শিবেন্দু মান্না, ২০১১
১৭. হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি - তারাপদ সাঁতরা, ১৯৭৬
১৮. পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা ( মেদিনীপুর জেলা সংখ্যা), জানুয়ারি ২০০৪
১৯. সপ্তডিঙা পত্রিকা ( কালীপুজো সংখ্যা),১৪২৬
২০. সমকালীন পত্রিকা - কার্তিক, ১৩৮৮
২১. Bengal District Gazetteer Howrah - L.S.S Omalley,1909
২২. West Bengal District Gazetteers Howrah -Amiya Kumar Banerji, 1972
২৩. Journal of the Asiatic Society of Bengal- C.R.Wilson,1892
২৪. Cambridge History of India( vol-3)- Dr. S.K. Ayangar
মানচিত্র সূচিঃ-
১. ডি. ব্যারোজ - ১৫৫৩
২. ভ্যান ডেন ব্রুক- ১৬৬০
৩. রেনেল- ১৭৮২
৪. পশ্চিমবঙ্গের নদ-নদী(ষোড়শ -সপ্তদশ শতাব্দী)

দশম পর্বঃ জাল্লাবাজের কথা (Jallabaz-er katha)

✍️   আশিস চক্রবর্তী  ও  অমলেন্দু বেরা হাওড়া জেলার দক্ষিনে শ্যামপুর থেকে গাদিয়াড়া সড়কের মধ্যে অবস্থিত গুজারপুর বাসস্টপ থেকে আড়াই কি. মি. দূরে...